Pratul Mukhopadhyay Passed Away ‘গানমানুষ প্রতুল মুখোপাধ্যায় আজীবন সকলের মনে থেকে যাবেন… ‘,সঙ্গীতশিল্পীর  প্রয়াণে শোকার্ত মুখ্যমন্ত্রী

0
27

অচেনা সাগরে ডিঙ্গা ভাসালেন প্রতুল মুখোপাধ্যায় ।প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়। শনিবার ভোরে তাঁর গানের পঙ্‌ক্তি মেনেই যেন অচেনা সাগরে ডিঙ্গা ভাসালেন। বয়স ৮৩ বছর। বছরের শুরু থেকেই অসুস্থতা কাবু করেছিল তাঁকে। তখন থেকে তিনি এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ বাংলা সঙ্গীত জগৎ।

সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, খবরটা শোনার পর থেকেই খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁর। নিজেকে সামলাতে পারছে না। তবে মমতার কথায়, তাঁকে সাময়িক বিদায় জানালেন তাঁরা। কারণ সঙ্গীতশিল্পী আজীবন সকলের মনে থেকে যাবেন।

জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেই প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেই সময় তাঁর নাক দিয়ে আচমকাই রক্তক্ষরণ হয়েছিল। অতিরিক্ত সংক্রমণে প্রভাব পড়ে কিডনি, ফুসফুসে। সম্প্রতি অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় ভেন্টিলেশনে ছিলেন তিনি। এদিন সকাল ১০টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘খবর শোনার পর আসতে বাধ্য হয়েছি, না এসে উপায় ছিল না। যেদিন থেকে তিনি হাসপাতালে ভর্তি, আমি খবর নিয়েছি। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেছিল…’

শেষ কয়েকদিন সঙ্গীতশিল্পীর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। মমতা জানান, এমন একটা পর্যায়ে তিনি চলে গেছিলেন যে তাঁকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। তিনি এও জানান, শুক্রবার মধ্যরাতে তাঁর প্রেসার হঠাৎ অনেক কমে যায়। তখন থেকেই হয়তো ডাক্তাররা বুঝতে পেরেছিলেন যে কিছু খারাপ হবে। শনিবার সকালেই সেই খারাপ খবরটাই আসে। মমতা বলেন, ‘এমন মানুষ আর আসবেন কিনা পৃথিবীতে আমি জানি না। তাঁর গান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ রবীন্দ্র সদনে গান স্যালুটে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয় প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে।

গত বছরও জানুয়ারি মাসে অসুস্থ হয়েছিলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি এসএসকেএম হাসপাতালে অসুস্থ সঙ্গীতশিল্পীকে দেখতে গিয়েছিলেন মমতা। শুধু তাই নয়, প্রতুলের গলায় “আমি বাংলার গান গাই” গানটিও শোনেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই ভিডিও নিজের ফেসবুকেও পোস্ট করেছিলেন মমতা। ক্যাপশনে লিখেছিলেন, “প্রতুলদার গলায় ‘বাংলার গান গাই’ এক সুখকর অভিজ্ঞতা।” এবারও কয়েকদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী এসএসকেএম হাসপাতালে দেখা করতে গেছিলেন সঙ্গীতশিল্পীর সঙ্গে। তাঁর প্রয়াণে এখন শোকস্তব্ধ তিনি। 

প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের জন্ম অবিভক্ত বাংলার বরিশালে। ১৯৪২ সালে। বাবা প্রভাতচন্দ্র ছিলেন স্কুলশিক্ষক, মা বীণাপাণি মুখোপাধ্যায় গৃহবধূ। দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়ায়। স্কুলে পড়াকালীনই তাঁর এক আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় পান নিকটজনেরা। মাত্র ১২ বছর বয়সে কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতাটিতে সুরারোপ করে বন্ধুদের চমকে দিয়েছিলেন প্রতুল। পাশাপাশি নিজেও লিখতে থাকেন ছড়া, গানের লিরিক। চাকরি করেছেন আর পাঁচজন মধ্যবিত্ত গেরস্তের মতোই। কিন্তু সেই গেরস্থালির মধ্যেই কোথাও যেন আগুন ছিল। ধিকিধিকি গানের আগুন। বিপ্লব, স্বপ্নভঙ্গ আবার বিপ্লব আর আবার স্বপ্নভঙ্গের বঙ্গীয় রাজনীতির অনেক উথালপাথালের সাক্ষী প্রতুল রাজনৈতিক বিশ্বাসে ছিলেন সমাজতন্ত্রের শরিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও বোধ হয় মানুষ আর মানবতাকে তাঁর গানে সবার আগে রাখতেন।

কোনও যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই শুধুমাত্র ‘বডি পারকাশন’ ব্যবহার করে গানের রেওয়াজ গণনাট্যের গানেও ছিল না। বরং সেখানে গান ছিল যূথবদ্ধ মানুষের হারমনির উপরে দাঁড়িয়ে। ‘কয়্যার’ বা যৌথ গানের সঙ্গে মানুষের অধিকার অর্জনের লড়াই বা দিনবদলের স্বপ্ন ইত্যাদির অঙ্গাঙ্গী যোগ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতুল সে রাস্তায় হাঁটলেন না। তাঁর গান সে অর্থে তাই ‘গণসঙ্গীত’ হয়েও যেন হল না। এমনকি, মঞ্চে গাওয়ার সময়েও (মঞ্চের বাইরেও হাটে-মাঠে-ঘাটে) কোনও যন্ত্রীকে সঙ্গে নিলেন না। কখনও নিজের গাল কখনও বা বুক বাজিয়ে, তুড়ি দিয়ে, হাততালি দিয়ে গাইতে লাগলেন নিজের বাঁধা গান। গায়ক একা হয়েও যেন একা নন। তাঁর সঙ্গী তাঁরই দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। প্রতুলের গান গণনাট্যের গানেরই উত্তরাধিকার হলেও তার থেকে তার স্বাতন্ত্র্য প্রধানত ওই এক জায়গাতেই।

প্রতুলের প্রথম অ্যালবাম ‘যেতে হবে’ (১৯৯৪) প্রকাশের পর একেবারে অন্য রকম এক শ্রুতির সামনে গিয়ে পড়েন শ্রোতারা। মঞ্চে প্রতুল যন্ত্রানুষঙ্গ বর্জন করলেও এই অ্যালবামে করেননি। তাঁর গানের পিছনে বহু দূরের দিগন্তরেখার মতো থেকেছে যন্ত্র। গানই সেখানে মুখ্য। ইন্টারল্যুডে প্রতুলের নিজেরই কণ্ঠ বেজেছে। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা! সর্বোপরি তাঁর কণ্ঠ, স্বরক্ষেপণ এবং উচ্চারণ। মধুমাখা বাংলা আধুনিকের জগতে সে যেন এক মূর্তিমান ভাঙচুর। ‘সুকণ্ঠ’ নিয়ে গরবে গুমরোনো বাংলা গানের জগতে প্রতুল তাঁর প্রবল রকমের ‘ম্যানারিজ়ম’ নিয়ে যেন সত্তর দশকের কবি সুব্রত সরকারের উচ্চারণেই বলে উঠলেন, ‘সহ্য করো, বাংলাভাষা’।

এরই সঙ্গে প্রতুল গেয়েছেন ছোটদের জন্য। ‘কুট্টুস কট্টাস’ নামের অ্যালবামে প্রায় প্রতিটি গানে রয়েছে কেমন এক সস্নেহ প্রশ্রয়ের টান। সুমন-নচিকেতা-অঞ্জনের ‘ছোট বড় মিলে’ আর প্রতুলের এই অ্যালবামই কি বাংলার শেষ ‘ছোটদের গান’? যে কাজ সলিল চৌধুরী শুরু করেছিলেন অন্তরা চৌধুরীকে দিয়ে, সেই কাজটি ছিল ছোটদের ‘বড়’ হয়ে ওঠার জন্য গান বাড়িয়ে দেওয়ার কাজ। প্রতুল তাঁর সেই অ্যালবামে সেই কাজেরই উত্তরাধিকার বইলেন।

সচরাচর কোনও বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন না প্রতুল মুখোপাধ্যায়। কিন্তু সেতারের সুর পছন্দ করতেন। পছন্দ করতেন স্পষ্ট ভাষায় কথা বলাও। আক্ষরিক অর্থেই। গান শুনতে শুনতে একটি অনুষ্ঠানে এক অনুরাগী তাঁকে জানান, পঙক্তির শেষের দিকের শব্দগুলি ঠিক মতো শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। তার পর থেকে উচ্চারণ নিয়ে মারাত্নক সতর্ক থাকতেন। বিকৃত উচ্চারণ পছন্দ করতেন না। তাঁর উচ্চারণের মতোই স্পষ্ট ছিল রাজনৈতিক বক্তব্যও। মানুষের মুক্তির গান বারবার উঠে এসেছে তাঁর গলায়। লিখেছিলেন, “ঘর দোর বেচো ইচ্ছা হলে, বেচো সোনা দানা, বেচো না বেচো না বন্ধু হাতের কলমখানি।”

একাধিক সাক্ষাৎকারে প্রতুল বলেছেন, সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। তাঁর ভাষায়, “আমি শুনে শুনে, ঠেকে ঠেকে শিখেছি।” তাঁর শ্রোতাদেরও প্রথমে হোঁচট খেতে হয়েছিল তাঁর গান শুনতে বসে। একজন মানুষ কণ্ঠ, প্রশিক্ষণ, পরিমার্জন— সব কিছুকে পাশে সরিয়ে রেখে কী করে হয়ে উঠছেন ‘আস্ত একটা গান’, তা আগামী প্রজন্মকে ভেবে উঠতে গেলেও ভাবনার জিমন্যাশিয়ামে ভাবা প্র্যাকটিস করতে হবে। কী করে সম্ভব হয়েছিল তা, এখন আর মনে পড়ে না নব্বই দশকে যুবক হয়ে উঠতে থাকা প্রজন্মের। মাথার উপর এক স্থবির রাজনীতি আর তার সুবাদে চারিপাশে ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’-সুলভ একটা ‘ফিল গুড’ ভাবকে যে হাতেগোনা কয়েক জন দুমড়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রতুল অন্যতম।

বাংলা ছিল তাঁর স্বপ্ন দেখার ভাষা। দ্রোহের ভাষা, ভালবাসার ভাষা। সেই ভাষাতেই আজীবন খালি গলায় গান গেয়ে গিয়েছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। শক্ত শব্দের থেকেও বেশি ভরসা করছেন মানুষের রোজকার সহজ সরল শব্দে। কঠিন শব্দের সঙ্গে অবলীলায় ব্যবহার করেছেন মুটে-মজুর, চাষা- জেলের ভাষা। তাঁর ‘আমি বাংলায় গান গাই’- তে সুর মিলিয়েছে কোটি কোটি বাঙালি।

নিজের কলমকেই আয়ুধ করেছেন। বড় আক্ষেপ ছিল, বাঙালিরাই বাংলা গান শোনেন না। অধ্যাপনা থেকে অবসরকাল, চেষ্টা করে গিয়েছেন ভাষার প্রতি তাঁর আজন্মলালিত ভালবাসা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার। শেষ বয়স পর্যন্ত দৃপ্ত গলায় গেয়ে গিয়েছেন বাংলা গান, বাংলার গান।  বাংলা যে তাঁর ‘দৃপ্ত স্লোগান, ক্ষিপ্ত তীর ধনুক’। সেই বাংলাতেই ‘তৃপ্ত শেষ চুমুক’ দিয়ে শনিবার বিদায় নিলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।

Previous articleLocal Train Cancel: বনগাঁ – বারাসত সহ কৃষ্ণনগর থেকে নৈহাটি  সপ্তাহান্তে ফের এক গুচ্ছ ট্রেন বাতিল শিয়ালদহ শাখায়
Next articleMaha Kumbh in Fire:চতুর্থবার বিধ্বংসী আগুনে জ্বলল মহাকুম্ভ , পুড়ল একের পর এক তাঁবু!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here