বিভাস রায়চৌধুরী :

প্রথমে বাসন্তী পুজো। নতুনগ্রামে রোজ রাতে যাত্রা দেখার আনন্দ। তারপর চড়ক। অবাক চোখে নতুনগ্রামের সন্ন্যাসীদের কাঁটায় ঝাঁপ দেখা। তার পরদিন পয়লা বৈশাখ। গরম পড়তেই আমাদের মন এইসব খুশিতে ভরে থাকত।

আমাদের রিফিউজি পাড়ায় পয়লা বৈশাখের আগে থেকেই আমার এবং ভাইয়ের (ঘরে ঘরে সমস্ত বন্ধুদের ও তাদের ভাই-বোনেদের‌ও) মনে খুশির ঝিলিক দিত যে, কাল পয়লা বৈশাখ নতুন গেঞ্জি প্যান্ট পাব আমরা। আর বিকেলে হালখাতা। বাবার সঙ্গে কয়েকটা দোকানে যাব আমরা। সেখান থেকে হাতে আসবে মিষ্টির প্যাকেট। এই মিষ্টিই আমাদের ছোটবেলার পয়লা বৈশাখ।

এখন তো নগরের গন্ধে গ্রাম মরছে। গ্রামীণ সংস্কৃতি তেমন দর পায় না। আদর পায় না। কার‌ও সামান্য উন্নয়ন হলেই সে শহরমুখী হয় এবং গ্রামের পাশে আর থাকে না। এই উন্নয়নের পথেই বাঙালি ভুলছে বাংলা। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভুলে অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির দাসত্ব করলে যে একটা জাতি বেজন্মা হয়ে যায়, তা অনেকেই ভেবে দেখছে না। নীল রং মাখলেই শিয়াল অন্য প্রাণী হয়ে যায় না। শিয়ালের প্রকৃত অস্তিত্ব সে শিয়াল‌ই। ইংরেজি, হিন্দি বা বিশ্বের যে-কোন‌ও ভাষাই একজন শিখতে পারে, কিন্তু নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে নীলবর্ণ শিয়ালের পরিণতিই অনিবার্য। অদ্ভুত ব্যাপার, আমেরিকা বা কানাডায় বাংলাদেশি বাঙালিরা বাংলা সংস্কৃতির ধ্বজা ওড়ায় আর ভারতীয় বাঙালিরা আত্মপরিচয় গোপন করে!

এখন পয়লা বৈশাখে একদিনের জন্য বাঙালি জাগে। অতি তৎপরতায় হাস্যকর হয়ে যায় তা অনেকাংশেই। বাংলাদেশের বাঙালিরা যখন অসাম্প্রদায়িক পহেলা বৈশাখ উৎসবে দেশ জুড়ে গানে-কবিতায়-নাটকে মাতোয়ারা, আমাদের এখানে পয়লা বৈশাখ তখন যেখানে যে ক্ষমতায় আছে, তার আস্ফালন ও আত্ম-প্রদর্শনে ভরা। কোন‌ও সুচিন্তার প্রতিফলন নেই।

আসলে বাংলা তারিখ অবহেলিত বলেই এখানে এরকম হয়। পয়লা বৈশাখ দুয়োরানী আর পয়লা জানুয়ারি সুয়োরানী। তার কারণ বাণিজ্য-সর্বস্ব মানুষের সভ্যতা।

তবে গরিব গ্রামে এখনও কিছুদিন পয়লা বৈশাখ বা বাংলা সংস্কৃতি টিকে থাকবে। বাবার সঙ্গে হালখাতার মিষ্টি আনতে যাবে ছেলে। ওই ছোট্ট খোকার মধ্যেই আমি নিজেকে দেখতে পাই। স্বপ্ন দেখি সে বাঙালিই থাকবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here