দেশের সময় : বনগাঁ শহরের উপর দিয়ে এশিয়ার বৃহত্তম স্থল-বন্দর পেট্রাপোলে পৌঁছনোর ছাড়পত্র দেওয়া হয় মিলন পল্লি মাঠের পার্কিং থেকেই। এত কাল এই কারবার দেখত বনগাঁ পুরসভা। সম্প্রতি ওই পার্কিং অধিগ্রহণ করে রাজ্য সরকারের পরিবহণ দফতর। তার পরেই পার্কিং চার্জে বদল এনে জারি করা হয় নয়া নির্দেশিকা।
ওই নির্দেশিকায় পার্কিং চার্জ দিনের হিসেবে ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০০ হয়ে গিয়েছে। ট্রাকভেদে কোথাও কোথাও তা ৯৬০ টাকা থেকে এক হাজার টাকাও হয়েছে। রফতানিকারক সংস্থার মালিকদের বক্তব্য, কোনও পণ্যবাহী ট্রাক মিলন পল্লি মাঠে এলেই তো তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। অন্তত ৩০-৩৫ দিন পার্কিংয়ে গাড়ি আটকে থাকে। তার পর মেলে ছাড়পত্র। আগে যেখানে পার্কিংয়ের জন্য সব মিলিয়ে ২ হাজার ৪০০ টাকা মতো গুনতে হত, সেখানে এখন দিতে হচ্ছে ২৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা!
বনগাঁয় রপ্তানী বানিজ্যের ট্রাক পার্কিং এর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলনে সামিল হয়েছে বানিজ্যের সঙ্গে যুক্ত একটি সংগঠন। পেট্রাপোল এক্সপোর্ট–ইমপোর্ট সমন্বয় কমিটি নামে নতুন একটি সংগঠন তৈরি করে তারা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, পরিবহন দপ্তর সহ বিভিন্ন স্তরে তাদের দাবি পেশ করেছেন। তাদের দাবি, অবিলন্বে পুরনো পার্কিং মূল্য চালু করতে হবে।
১৯৯৫ সালে বনগাঁ পুরসভার উদ্যোগে মিলনপল্লীতে পার্কিং জোন তৈরি হয়। শুরুতে ট্রাক প্রতি মূল্য ছিল দৈনিক ৫ টাকা। সেই মূল্য একটু একটু করে বেড়ে বর্তমানে দাঁড়ায় ৮০ টাকা। ৭ ফেব্রুয়ারী থেকে এই পার্কিং এর দায়িত্ব নেয় রাজ্য পরিবহন দপ্তর। আর তখন থেকেই নতুন মূল্য কার্যকরী হয়।
নতুন তালিকা অনুযায়ী সেখানে দেখা যাচ্ছে, একদিনের জন্য এই পার্কিং এ গাড়ি রাখতে দিতে হচ্ছে প্রায় ৯৬০ টাকা। ব্যবসায়ীদের দাবি, এই পার্কিং এ একটি গাড়ি প্রবেশ করার পর সেই গাড়ি পেট্রাপোল সীমান্তের উদ্দেশ্যে যাবার অনুমতি পেতে ৩০ থেকে ৪০ দিন লেগে যায়। ফলে এতোদিন দাঁড়িয়ে থাকার কারণে নতুন মূল্য তালিকা অনুযায়ী একেকটি গাড়িকে পার্কিং চার্জ বাবদ ২৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে।
পেট্রাপোল সীমান্তে পৌঁছনোর আগে বনগাঁর মিলন পল্লি মাঠের পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পণ্য-পরিবহণকারী ট্রাকের পার্কিং চার্জ দিন প্রতি ৮০ টাকা থেকে একলাফে বেড়ে ৮০০ টাকা হওয়ায় ক্ষুব্ধ রফতানিকারক সংস্থার মালিকেরা। পার্কিং চার্জ কমানোর দাবিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে অবস্থান-বিক্ষোভ শুরু করেন তাঁরা। দিনের পর দিন পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় বহু ট্রাকের পার্কিং বিল ছুঁয়েছে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার টাকা। এই পরিমাণ টাকা দেওয়ার সামর্থ্য না-থাকায় গত শুক্রবার কোনও গাড়িই বার হয়নি পার্কিং থেকে। রাজ্য সরকারের এই পার্কিং চার্জ বাড়ানোর সিদ্ধান্তের জেরেই অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ বিজেপি-র।
বনগাঁর বিধায়ক অশোক কীর্তনীয়া বলেন , বিধানসভায় পার্কিং সমস্যার বিষয়টি তুলে ধরেছি এবং দ্রুত সমাধানের জন্য অনুরোধ জানিয়েছি যাতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ।
পেট্রাপোল এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট মেনটেন্যান্স কমিটির সদস্য অসীম সেন বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারের যে আধিকারিকেরা এই নির্দেশিকা জারি করেছেন, তাঁরা হয়তো জানেন না, এখানে কোনও কোনও ট্রাক ৪০-৪৫ দিনও দাঁড়িয়ে থাকে। গত কাল (বৃহস্পতিবার) কালীতলা (মিলন পল্লি মাঠ) পার্কিং থেকে কোনও গাড়ি বার করা যায়নি। কারণ, কারও কাছে এত টাকা ছিল না। এত দিন কোভিডের কারণে এমনিতেই ব্যবসার অবস্থা খারাপ। তার মধ্যে পার্কিংয়ের জন্য এত টাকা কি দেওয়া সম্ভব?’’
রফতানিকারক সংস্থার মালিকদের আরও দাবি, শুধু পেট্রাপোলে যাওয়ার জন্যই মোটা টাকা দিতে হচ্ছে। ঘোজাডাঙা হিলির মতো অন্য সীমান্তে যাওয়ার জন্য পার্কিং চার্জ বাড়ানো হয়নি। তাঁদের হুঁশিয়ারি, রাজ্য পরিবহণ দফতর যদি পার্কিং চার্জ না কমায়, তা হলে পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে তাঁরা পণ্য রফতানি করবেন না। অন্য সীমান্তে চলে যাবেন। নয়তো জাহাজ বা রেলে পণ্য পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।
পার্কিং চার্জ কমানোর দাবিতে জেলাশাসকের দফতরেও দরবার করেছেন রফতানিকারক সংস্থার মালিকেরা। বিষয়টি দ্রুত খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে সেখান থেকে।
জেলাশাসকের দফতর সূত্রে খবর, পার্কিং চার্জ বাড়ানো হলেও পেট্রাপোলে যাওয়ার ছাড়পত্র যাতে এক-দেড় মাসের পরিবর্তে দু’-তিন দিনের মধ্যেই পাওয়া যায়, সেই ব্যবস্থাই করছে রাজ্য সরকার। এতে মেরেকেটে ওই আগের পরিমাণ টাকাই লাগবে পার্কিংয়ের জন্য। পাল্টা দাবি, রাজ্য সরকার যদি দু’-তিন দিনের মধ্যে ছাড়পত্র দেওয়ার কথা ভাবে, তা কার্যত অসম্ভব। কারণ, তার জন্য যশোর রোডের রাস্তা যতটা চওড়া হওয়া বাঞ্ছনীয়, বাস্তবে তা নয়। ফলত, দিনের সংখ্যা কমে দশ হলেও আগের তুলনায় সেই মোটা টাকাই গুণতে হবে রফতানিকারণ সংস্থার মালিকদের।
এই অবাস্তব মূল্য বাতিল করে পুরনো তালিকা অনুযায়ী পার্কিং চার্জ নেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। সরকার তাদের দাবি না মানলে আগামী দিনে পেট্রাপোল সীমান্তের রপ্তানী বানিজ্য ক্ষতির মুখে পরবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
আন্দোলনের জেরে গত বৃহস্পতিবার থেকে মিলনপল্লী পার্কিং থেকে কোনও ট্রাক বের করেন নি ব্যবসায়ীরা। সমস্যা না মিটলে যে কোন সময় পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পণ্যবোঝাই ট্রাক যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
পার্কিং চার্জ বাড়ানোর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিজেপি-র বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সাধারণ সম্পাদক দেবদাস মণ্ডল বলেন, ‘‘বনগাঁর অর্থনীতি সীমান্ত-বাণিজ্যের উপর নির্ভর করে। সেখানে এত টাকা পার্কিং চার্জ! কেউ দিতে পারে নাকি! রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে বনগাঁ ব্যবসায়ীদের।’’
তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি নায়ারণ ঘোষ বলেন, ‘‘ঘটনাটা শুনেছি। দলের শীর্ষনেতৃত্বকে আমি জানাব। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করা হবে।’’
এব্যাপারে বনগাঁর মহকুমা শাসক প্রেমবিভাস কাঁসারী জানান, ‘ব্যবসায়ীদের দাবি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। এব্যাপারে তারা যা সিদ্দান্ত নেবেন, আগামীদিনে সেভাবেই কাজ হবে।’
পার্কিং চার্জ বৃদ্ধির প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাতেও বনগাঁ রামনগর রোডের মোড়ে ফের রাস্তা অবরোধ করেঅবস্থান-বিক্ষোভে সামিল হন ইমপোর্ট -এক্সপোর্ট সমন্বয় কমিটির সদস্যরা। ঘটনাস্থলে পৌঁছায় বনগাঁ থানার পুলিশ ৷
বাগদার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস জানান, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে আগামীতে এই সমস্যার কথা রাজ্য সরকারকে তিনি জানাবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন বিধায়কের দেওয়া আশ্বাসে অবরোধ গত বৃহস্পতিবার অবরোধ তুলে নিয়েছিল ব্যবসায়ীরা ।
ফের রবিবার রাতে বাটার মোড়ে বিক্ষোভ শুরু করে এক্সপোর্ট ইমপোর্ট সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে । বিক্ষোভের জেরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে যশোর রোড । একই ভাবে মঙ্গলবার রাতে অবরোধ শুরু করে পেট্রাপোল এক্সপোর্ট ইমপোর্ট সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে । প্রায় ২ ঘণ্টা অবরোধ চলেছে এদিন । অবরোধকারীদের দাবি প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে একাধিকবার পার্কিং চার্জ কমানোর দাবি জানানো সত্ত্বেও কোনো সদুত্তর মেলেনি , প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললো কিন্তু রাজ্য সরকার তাঁদের দবিতে কর্ণপাত করছে না বলে অভিযোগ তুলে এই অবরোধ কর্মসূচি বলে জানান।
পেট্রাপোল এক্সপোর্টার্স এ্যান্ড ইমপোর্টার্স ওয়েল ফেয়ার এ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক প্রদীপ দে বলেন, রফতানি পণ্য পার্কিংয়ে রাখলে তার খরচ আমাদের দিতে হয় ৷ পার্কিংয়ে ট্রাক রাখার পরে পেট্রাপোল বন্দরে আসতে ৩০-৪০ দিন সময় লাগে৷ এই পরিস্থিতিতে পার্কিং ফি বাড়ানোর ফলে আমরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছি। প্রশাসনের কাছে আবেদন, ফি কমানো হোক৷ তবে আমদানি রফতানির কাজ চালু রেখে সমস্যা সমাধান করা হোক৷
পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী জানান, গোটা বিষয়টি রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে৷ পে্ট্রাপোল বন্দরে আমদানি -রফতানির কাজ ব্যহত হলে সর্বস্তরেই তার প্রভাব পড়ে৷ ব্যাবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতির কথা মাথায় রেখে রাজ্য সরকার এই পার্কিং চার্জ বৃদ্ধি সহ শহরের মধ্যে জানজট বৃদ্ধির বিষয় টিও খতিয়ে দেখে তার সুব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আশাবাদী আমাদের সংগঠন৷