দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ এই সবে আমরা একটা মহামারী কাটিয়ে উঠলাম। করোনা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। কিন্তু আমাদের অগোচরে আরও এক মহামারীর পথ ক্রমেই প্রশস্ত হচ্ছে। অল ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন ওবেসিটির সম্মেলন হয়েছে ২০২৩ সালের শেষের দিকে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যোগ দেন ওই সম্মেলনে। আলোচনায় যে বিষয়টি নিয়ে তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তা হল স্থূলতা। আশ্চর্যের এটাই যে, গোটা পৃথিবীর চিকিৎসকরা স্থূলতা বা বাড়তি ওজন নিয়ে যতটা না চিন্তিত, তার চেয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন আরও একটি কারণে, সেটি হল মহামারীর আকার নেওয়া স্থূলতার জেরে ঘরে ঘরে হানা দেবে নানা রোগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাইপারটেনশন থেকে ডায়াবেটিস বা বন্ধ্যত্বের মতো গুরুতর রোগ শরীরে বাসা বাঁধবে শুধুমাত্র ওবেসিটির কারণে।

চাইল্ড ওবেসিটির বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রীতি ফাটালে ইতিমধ্যেই সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, এই মুহূর্ত থেকে যদি আমরা সজাগ না হই, তাহলে ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষ ওবেসিটির শিকার হবেন। ওয়ার্ল্ড ওবেসিটি ফেডারেশনের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ২৭ মিলিয়নের বেশি তরুণ স্থূলতার সমস্যায় ভুগবে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৫ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষ স্থূল হিসেবে চিহ্নিত হবেন। ৩৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক বাড়তি ওজনের সমস্যায় ভুগবেন।
সমীক্ষা বলছে, প্রতি বছর ছেলেদের মধ্যে অন্তত একশো শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে ১২৫ শতাংশ হারে ওবেসিটি বাড়ছে। তবে সবচেয়ে যেটা উদ্বেগের তা হল, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় অল্পবয়সিদের মধ্যে ওবেসিটি বৃদ্ধির হার বেশি। কমবয়সিদের ক্ষেত্রে যেখানে ওবেসিটি ৯.৭ শতাংশ, সেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই হার ৫.২ শতাংশ।

চিকিৎসক প্রীতি ফাটালে বলছেন, শিশুদের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে ওবেসিটি প্রাপ্ত বয়সেও বাহক হিসেবে থেকে যায়। এর থেকে শরীরে বাসা বাঁধে নানা রোগ। এমনকী দেখা দিতে পারে বন্ধ্যত্বের মতো গুরুতর সমস্যা।
তথ্য বলছে, ১৯৯০ সালে দেশে সাকুল্যে চার লক্ষ শিশুর ওবেসিটি ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তা বেড়েছে। ২০২২ সালের হিসেব বলছে, ওবেসিটিতে ভুগছে এখন এমন শিশুর সংখ্যা ১২.৫ মিলিয়ন। অর্থাৎ গোটা দেশে এক কোটি আড়াই লক্ষ শিশু এই মুহূর্তে ওবেসিটির শিকার। এর মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা ৭৩ লাখ। মেয়েরা রয়েছে ৫২ লাখ।

পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, পুরুষদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজনের প্রবণতা গত কয়েক দশকে বেড়েছে প্রায় ২৩ গুণ। ১৯৯০ সালে দেশে মাত্র ১.১ লাখ পুরুষ স্থূল ছিলেন। কিন্তু ২০২২ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, ২৬ মিলিয়ন অর্থাৎ দু’কোটি ৬০ লক্ষ পুরুষ স্থূলতার সমস্যায় ভুগছে। অন্যদিকে, এই সময়কালে মহিলাদের মধ্যে ওবেসিটি বেড়েছে ১৮ গুণ। ১৯৯০ সালে ২.৪ মিলিয়ন অর্থাৎ ২৪ লক্ষ মহিলা ওবেসিটিতে আক্রান্ত ছিলেন। সেখোনে ২০২২ সালে এসে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৪৪ মিলিয়ন অর্থাৎ চার কোটি ৪০ লক্ষ। তাহলে আরও দু’বছর পর ২০২৪ সালে ছবিটা কোন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তা নিশ্চয়ই অনুমেয়।
ওবেসিটির কারণ কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাদিন বসে কাজ। খুব বেশি হাঁটাচলা না করা। যত ক্যালোরি খাবার খাচ্ছি, ততটা খরচ হচ্ছে না। ফলে শরীরে জমছে মেদ। পরিমাপের বেশি খাওয়ার প্রবণতা। নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা না করা। ফাস্টফুড ও জাঙ্কফুড খাওয়ার প্রবণতা মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়া।
ওবেসিটি থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় কী?
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সবার প্রথম অভ্যাসে বদল আনতে হবে। ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড একেবারেই খাওয়া চলবে না। নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করতে হবে। বডি মাস ইনডেক্স ২৫-৩০ এর মধ্যে থাকতে হবে।

দিল্লির বিশিষ্ট চিকিৎসক অমিত গুপ্ত বলছেন, ওবেসিটি থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায়, রোজ শরীরচর্চা করতে হবে। তাহলেই যদি স্থূলতার মহামারী ঠেকানো যায়। তবে শুধু হাঁটলে চলবে না। রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ করতে হবে।
ডাঃ গুপ্তর মতে, কায়িক পরিশ্রম করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। তবে যাঁদের সেই সুযোগ নেই, তাঁরা অ্যারোবিকস বা ওজন নিয়ে শরীরচর্চা শুরু করুন। রোজ না হলেও সপ্তাহে কমপক্ষে তিনদিন এটা করতেই হবে। না হলে স্থূলতা মহামারী ঠেকানো মুশকিল। তাঁর মতে, স্থূলতার সঙ্গে গর্ভধারণের ভীষণ নিবিড় সম্পর্ক। অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন ওজন এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ ঠিকঠাক না থাকলে মা ও সন্তান উভয়ের ক্ষেত্রেই বিপদের ঝুঁকি থেকে যায়।
স্থূলতা নিয়ে যে সমস্যা বাড়ছে, সে ব্যাপারে আলোচনা চলছে বহুদিন ধরেই। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে ওবেসিটি আক্ষরিক অর্থেই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এনিয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, শিশুদের খাওয়াদাওয়া ও খেলার অভ্যাসে নজর দিতে হবে অভিভাবকদের। কারণ, মোটা হয়ে যাওয়ার সমস্যা শুরু হয়ে যাচ্ছে একেবারে ছোটবেলা থেকে। আর এর মূল কারণ, ঘরোয়া খাবার ছেড়ে শিশুদের ফাস্টফুডের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়া।
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, স্থূলতার সমস্যা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে, ১৮-২৪ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে। দেখা গিয়েছে, এই বয়স থেকে যদি ওজন বাড়তে শুরু করে, তাহলে পরের বছর দশেকের মধ্যে তা মারাত্মক আকার নেয়।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও বার্লিন ইনস্টিটিউট অব হেল্থ-এর গবেষকরা একটি গবেষণা চালান। সেই গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ল্যানসেট জার্নালে। তাতে বলা হয়েছে, জাতি-শ্রেণি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে ১৮-২৪ বছর বয়সিরা স্থূলতার সমস্যায় সবচেয়ে সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে ভুগছে। বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০ লক্ষ মানুষকে নিয়ে চালানো হয়েছে ওই সমীক্ষা। রিপোর্টের ভিত্তিতে গবেষকরা দেখেছেন, যদি কেউ ১৮-২৪ বছর বয়স থেকে স্থূলতার সমস্যায় ভোগা শুরু করেন, তাহলে পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে তাঁর এই সমস্যা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই বয়স ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কেন এই বয়স থেকে ওজন বাড়তে থাকে?
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ১৮-২৪ বছর বয়স এমন একটি সময়, যখন ছেলেমেয়েরা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে থাকেন। ফলে এসময় থেকেই তাঁদের জীবনে নতুন কিছু অভ্যাস তৈরি হয়। বদল আসে জীবনযাত্রায়। যা পরের দশ বছরেও থেকে যায়। বদলে যাওয়া সেই অভ্যাসই ডেকে আনে স্থূলতার মতো মারাত্মক সমস্যা।
ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভের শেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ সালে ভারতে পাঁচ জনের মধ্যে একজনের স্থূলতার সমস্যা ছিল। কিন্তু ২০২০-২১ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি চারজনে একজন।
কোনও ব্যক্তি স্থূলতায় আক্রান্ত কি না তা তাঁর বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই দেখে বোঝা যায়। বিএমআই যদি কারও ৩০-এর বেশি হয়, সেক্ষেত্রে বলা হয় সংশ্লিষ্ট ওবেসিটিতে আক্রান্ত। আর যদি বিএমআই ২৫-২৯.৯-এর মধ্যে থাকে, তাহলে বলা হয় সেই ব্যক্তির ওজন বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বলছে, ১৯৭৫-২০১৬ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী স্থূলতার প্রকোপ বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। একসময় ধনী দেশগুলিতেই ওবেসিটি দেখা যেত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, নিম্ন আয় কিংবা মধ্য আয়ের দেশেও হু হু করে বাড়ছে স্থূলতার সমস্যা।

গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ (জিবিডি)-এর সমীক্ষা বলছে, ওবেসিটির কারণে ২০১৯ সালে ৫০ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি কীরকম জানেন? বছরে এইচআইভি বা এডসের কারণে যত মানুষের মৃত্যু হয় স্থূলতার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা তার চেয়ে প্রায় ছ’গুণ বেশি। আরও একটি তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে গোটা বিশ্বে যত জন মারা গিয়েছে, তার প্রায় ৮ শতাংশ মানুষ মারা গিয়েছেন ওবেসিটির কারণে। ১৯৯০ সালে এই সংখ্যাটা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। তাহলে এবার ভাবুন কত দ্রুততার সঙ্গে বিপদ ঘনিয়ে আসছে।
তথ্য বলছে, ১৫-৪৯ বছর বয়সি পুরুষের মধ্যে ওবেসিটিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৩ শতাংশ। মহিলাদের মধ্যে এই প্রবণতা ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশ।
ওবেসিটির ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। গ্রামে রোগা পুরুষের সংখ্যা তুলনায় বেশি, ১৮ শতাংশ। শহরাঞ্চলে এই অনুপাত ১৩ শতাংশ। অন্যদিকে, শহরে ৩০ শতাংশ পুরুষ স্থূলতার শিকার। গ্রামীণ এলাকায় ১৯ শতাংশ পুরুষের ওজন স্বাভাবিকের থেকে বেশি।

পারিবারিক আয়ের সঙ্গেও স্থূলতার সম্পর্ক রয়ে গিয়েছে। দেখা গিয়েছে, নিম্ন আয়ের পরিবারে রোগা মহিলার অনুপাত ২৮ শতাংশ। কিন্তু উচ্চ আয় সম্পন্ন পরিবারে এই অনুপাত ১০ শতাংশেরও কম।
রাজ্য ভিত্তিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিহারে রোগা পুরুষের অনুপাত সবচেয়ে বেশি ১২ শতাংশ। এরপর রয়েছে মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাত। সেখানে এই অনুপাত ২১ শতাংশ। দেশে ওবেসিটি আক্রান্ত পুরুষের মধ্যে সবার উপরে রয়েছে দিল্লি ৩৮ শতাংশ। তামিলনাড়ুতে ৩৭ শতাংশ এবং কেরলে ৩৬ শতাংশ।
মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, সর্বাধিক রোগা মহিলার হিসেবে এগিয়ে রয়েছে ঝাড়খণ্ড ও বিহার। এখানে অনুপাত ২৬ শতাংশ। এরপর রয়েছে গুজরাত ও দাদরা-নগর হাভেলি এবং দমন ও দিউ। এখানে অনুপাত ২৫ শতাংশ। স্থূল মহিলার পরিসংখ্যানে পুদুচেরি সবার উপরে ৪৬ শতাংশ। চণ্ডীগড় ৪৪ শতাংশ, দিল্লি, তামিলনাড়ু ও পাঞ্জাবে ৪১ শতাংশ এবং কেরল ও আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ৩৮ শতাংশ।
