
গত ১০ মে, শনিবার বিকেল ৫টার সময়ে ভারত-পাক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। তার ৫১ ঘণ্টা পর সোমবার রাত ৮টায় জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, অপারেশন সিঁদুর বন্ধ হয়নি। তা স্থগিত হয়েছে মাত্র। পাকিস্তানের প্রতিটি পদক্ষেপের উপর আমরা নজর রাখছি। আমাদের তিন বাহিনী সমরসজ্জায় প্রস্তুতও রয়েছে। দরকার পড়লেই ফের জবাব দেব।
কূটনীতির একটা ভাষা থেকে। রাষ্ট্রের উদ্দেশে রাষ্ট্রের বার্তা বা হুঁশিয়ারিরও কমবেশি একটা গত দেখা গিয়েছে এতদিন। কিন্তু সোমবার পাকিস্তানের উদ্দেশে যেভাবে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তা যেন বেনজির। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর এই কথাগুলোই যেন শুনতে চাইছিলেন অনেকেই।
এদিন দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার বয়ান ও শব্দচয়ন ছিল শোনার মতই। যেন প্রতিটি শব্দ খুঁজে খুঁজে এনে বসানো হয়েছে। এমন সব শব্দ ও শব্দবন্ধ যা রক্তে আগুন ঢেলে দিতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী এদিন বলেন, “অপারেশন সিঁদুর শুধু একটা নাম নয়, দেশের কোটি কোটি মানুষের আবেগের প্রতীক। অপারেশন সিঁদুর ন্যায়ের অখণ্ড প্রতিজ্ঞা। ৬ মে রাতে তথা ৭ মে ভোরে এই প্রতিজ্ঞা ও শপথের অভিঘাত দেখেছে বিশ্ব”।
প্রধানমন্ত্রী এদিন বলেন, “অপারেশন সিঁদুর শুধু একটা নাম নয়, দেশের কোটি কোটি মানুষের আবেগের প্রতীক। অপারেশন সিঁদুর ন্যায়ের অখণ্ড প্রতিজ্ঞা। ৬ মে রাতে তথা ৭ মে ভোরে এই প্রতিজ্ঞা ও শপথের অভিঘাত দেখেছে বিশ্ব”।
প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “আজ সমস্ত সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গি সংগঠন বুঝে গিয়েছে, ভারতের মা বোনেদের সিঁথির সিঁদুর মুছে দিলে তার কী পরিনাম হতে পারে। ওরা আমাদের মা বোনেদের সিঁথির সিঁদুর মুছে দিয়েছে, আমরা ওদের জঙ্গি শিবির মাটিয়ে মিশিয়ে দিয়েছি। শুধু একশর বেশি সন্ত্রাসবাদীই খতম হয়নি। তাদের অনেক মুরুব্বিও খতম হয়েছে”।

পহেলগাম হামলার পর দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের মতো উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যে, পাকিস্তানের দিক থেকে একের পর এক নেতা-মন্ত্রী ভারতে পরমাণু হামলার হুমকি দিয়েছেন। জঙ্গি হামলার প্রতিক্রিয়ায় সিন্ধু জল চুক্তি রদ-সহ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছিল নয়াদিল্লি। এর পরেই পাকিস্তানের রেলমন্ত্রী হানিফ আব্বাসি ভারতের বিরুদ্ধে পারমাণবিক প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, পাকিস্তানের ঘোরি, শাহিন এবং গজনবির মতো ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১৩০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড, শুধুমাত্র ভারতের জন্যই রেখে দিয়েছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তানে জল সরবরাহ বন্ধ করলে ভারতের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।
এখন প্রশ্ন হল, যুদ্ধবিরতির ৫১ ঘণ্টা পর হঠাৎ করে কেন জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দিলেন প্রধানমন্ত্রী। কেন তা দরকার পড়ল? এই বক্তৃতার তাৎপর্য কী?

পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, ৭ মে ভোর রাতে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের উপর আঘাত হানার পর দেশবাসীর প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিল। পহেলগামে যেভাবে ধর্ম জানতে চেয়ে ২৬ জন নিরীহ পর্যটককে জঙ্গিরা হত্যা করেছিল, তার আরও কঠোর জবাব আশা করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু চার দিনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় তাঁরা যারপরনাই হতাশ হন। মনোভাব এমনই ছিল, নরেন্দ্র মোদীর কাছে এটা আশা করা যায় না। পাকিস্তানের মাজা আরও ভেঙে দেওয়া দরকার ছিল। শুধু যুদ্ধবিরতির ব্যাপারটাই নয়, যুদ্ধ থামাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিগ ব্রাদারের মতো আচরণ করেছেন, তাও কিছুটা অস্বস্তি তৈরি করেছে।
দেশের বৃহৎ অংশের মানুষের এই মনোভাব বুঝেই সম্ভবত এদিন জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, যুদ্ধবিরতি মানেই অপারেশন শেষ নয়। আপাতত অপারেশন সিঁদুর স্থগিত রাখা হয়েছে। দরকার হলে ফের আঘাত করা হবে।

প্রধানমন্ত্রী এদিন বলেন, “যুদ্ধের ময়দানে পাকিস্তানে ধুলো চাটিয়ে ছেড়েছি। অপারেশন সিঁদুর নয়া অধ্যায় জুড়েছে। নতুন যুগের যুদ্ধবিগ্রহে ভারত শ্রেষ্ঠতা দেখিয়েছে”। তিনি আরও বলেন, “অপারেশন সিঁদুর হল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের নীতি। তা নতুন লক্ষণরেখা তৈরি করে দিয়েছে। নিউ নর্মাল তৈরি করে দিয়েছে। এর পর কোনও জঙ্গি কার্যকলাপ ঘটলে ফের সেখানেই আঘাত করবে যেখান থেকে এই সন্ত্রাসবাদের শিকড় গজায়। পরমাণু অস্ত্র নিয়ে কোনও ব্ল্যাকমেল ভারত মুখ বুজে সহ্য করবে না”।
মোদীর কথায়, “নিশ্চিত ভাবে এই যুগ যুদ্ধের নয়। কিন্তু এই যুগ সন্ত্রাসেরও নয়। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কোনও সহিষ্ণুতা দেখানো হবে না”।
প্রধানমন্ত্রী এদিন এও ফের স্পষ্ট করে দেন, আগামী দিনে পাকিস্তানের সঙ্গে যদি কখনও আলোচনা হয়, তাহলে তা সন্ত্রাস নিয়েই হবে। তা পাক অধিকৃত কাশ্মীর নিয়েই হবে। সন্ত্রাস ও আলোচনা একসঙ্গে চলতে পারে না। “সন্ত্রাস ও বাণিজ্যও একসঙ্গে চলতে পারে না। জল আর রক্তও এক সঙ্গে বইতে পারে না। বিশ্বকে বলতে চাইব, আমাদের নীতি হল। পাকিস্তানের সঙ্গে কথা হলে সন্ত্রাস নিয়ে হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে কথা হলে পিওকে নিয়েই হবে”।
তাঁর কথায়, “আজ বুদ্ধ পূর্ণিমা। ভগবান বুদ্ধ আমাদের শান্তির রাস্তা দেখিয়েছে। শান্তির রাস্তাও শক্তির মধ্যে দিয়েই যায়”।