দেশের , কলকাতা :সোমবার নবান্ন সভাঘরে পুরসভার চেয়ারম্যানদের নিয়ে বৈঠকে একেবারে অগ্নিশর্মা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলা বৈঠকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধমকের পর ধমক। এমনকী এতদিন যে অভিযোগগুলি বিরোধীদের মুখে শোনা যেত, এখন সেই অভিযোগই শোনা গেল মুখ্যমন্ত্রীর গলায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন বলেন, ‘আমি টাকা তোলার মাস্টার চাইছি না। আমি জনসেবক চাইছি। আগামী দিন তাঁরাই টিকিট পাবেন।’ মুখ্যমন্ত্রীকে এ কথাও বলতে শোনা যায়, ‘বাংলার আইডেন্টিটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কেন বুঝতে পারছেন না? আপনার টাকা খাওয়ার জন্য, আপনাদের টাকা খাওয়ার জন্য।’
সোমবার নবান্ন সভাঘরে প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব থেকে জনপ্রতিনিধি , মুখ্যমন্ত্রীর ভর্ৎসনা থেকে ছাড়া পেলেন না কেউই। এমনকি, কয়েক জনের নাম করে কাজের সমালোচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতা, হাওড়ার রাস্তার অবস্থা দেখে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, ‘‘এ বার কি আমাকে রাস্তা ঝাঁট দিতে বেরোতে হবে? শুধু উপর দেখলে হবে? নীচে দেখতে হবে না? রাস্তা দেখে না, আলো দেখে না! শুধু ট্যাক্স বাড়ানো আর লোক বসাচ্ছে! এ ছাড়া প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না!
এতদিন এসব অভিযোগ শোনা যেত বিরোধীদের গলায়। আর এবার মুখ্যমন্ত্রীও প্রশ্ন তুলে দিলেন ‘টাকা তোলার’ অভিযোগ নিয়ে। সোমবার নবান্নের বৈঠকে মমতা বলেন, ‘যদি দেখি কোথাও জবরদখল হচ্ছে, যখন হচ্ছে, তখন কেন অ্যাকশন নিচ্ছি না?… কেউ টাকা খেয়ে, কেউ টাকা খাইয়ে এবং একটা মাল্টিপল ইন্টারেস্ট গ্রুপ এগুলো করছে, টাকার বিনিময়ে।’ এলাকা ধরে ধরে এদিনের বৈঠকে প্রশ্ন তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। কখনও হাওড়া, কখনও সল্টলেক… যেখানে যেখানে গাফিলতির অভিযোগ রয়েছে, কাউকে রেয়াত করলেন না মুখ্যমন্ত্রী।
বেশ কয়েকটি এলাকার নাম উল্লেখ করে মমতা মন্তব্য করেন, ‘‘দেখেন না, লজ্জাও লাগে না? জনগণ পরিষেবা না পেলে পুরসভা-পঞ্চায়েত রেখে লাভ কী?’’ মুখ্যমন্ত্রী জানান, কোথাও ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা থাকলে সেটাও খুলে নিয়ে বিক্রি করে দেন অনেকে। তার জন্য কেন একটা সিস্টেম তৈরি হচ্ছে না? কেন জল অপচয় হচ্ছে? ‘অটোমেটেড’ কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?
আবার হাওড়ার কথা উল্লেখ করে মমতা বলেন, ‘‘কেউ টাকা খেয়ে, কেউ টাকা খাইয়ে এ সব করাচ্ছেন। রাজ্য সরকারের জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন। হাওড়া পুলিশকে বলব একটা তদন্ত করার জন্য। চিফ সেক্রেটারিকেও অর্ডার দিচ্ছি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘রাম-শ্যাম, যদু-মধু যে-ই হোন, আমিও যদি হই, ছাড়বেন না। লোভ বেড়ে যাচ্ছে। লোভটাকে কমাতে হবে। সরকারি জমি দখল করে একটার পর একটা বড় বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। রাজ্য সরকার নতুন রাস্তা তৈরি করেছে। তার রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। কেন এ সব হবে? দেখার দায়িত্ব কেবল আমার?’’
এই ভর্ৎসনার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী একটি দৃঢ় সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। তিনি জানান, এ বার থেকে জমি বণ্টন থেকে সৌরশক্তি, যে কোনও কাজের টেন্ডার আর স্থানীয় প্রশাসন দিয়ে পরিচালনা করা হবে না। তিনি বলেন, ‘‘এ গুলো উপর থেকে দেখতে হবে। এর জন্য কমিটি গড়ে দেব। কিন্তু লোকালি কাকে দিয়ে করব এগুলো? এসডিওকে দিলেও যা, ডিএমকে দিলেও তাই।’’
এদিন রাজ্যের সমস্ত পুরসভার কাউন্সিলর, জেলা শাসক ও পুলিশ কর্তাদের নমুখ্যমন্ত্রী পষ্টাপষ্টিই বলেন, কাউন্সিলরদের মধ্যে অনেকেই সরকারি জমিতে বাইরের লোক বসিয়ে দিচ্ছেন। তার পর টাকা তুলছেন। এতে বাংলার পরিচয়ই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তবে সুজিতকে এদিন যেভাবে নিশানা করেছেন, তা অনেকেরই নজরে পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর এদিনের বৈঠক সমাজ মাধ্যমে লাইভ হয়েছে। অর্থাৎ গোটা রাজ্যের সামনেই দমকল মন্ত্রীর ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মমতা।
বাংলা ও বাঙালির স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে ইদানীং বাংলা পক্ষ নামে একটি সংগঠন হয়েছে। কলকাতা তথা রাজ্যে অবাঙালি জনগোষ্ঠীর রমরমার বিরুদ্ধে যারা সুপরিকল্পিত ভাবে প্রচার চালাচ্ছেন।
সরাসরি সেরকম কোনও কথা না বললেও সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন, বাংলা আর বাইরের বোঝা ঘাড়ে নেবে না। তাঁর এও উদ্বেগ যে, বাইরে থেকে বেশি সংখ্যা লোক ঢুকে পড়ায় বাংলার সংস্কৃতি বিপন্ন হচ্ছে। বাংলার নিজস্বতা, পরিচয় ও চরিত্র নষ্ট হচ্ছে। এর পর হয়তো বাংলায় কথা বলার লোকই পাওয়া যাবে না।
মমতা বলেন, “বাইরের লোকেরা এসে এখানে সব জমি দখল করে নিচ্ছে। টাকার বিনিময়ে তা করছে। বড় বড় কমপ্লেক্স পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে সরকারি জমি দখল করে।” মুখ্যমন্ত্রী এও বলেন, বাইরে থেকে যাঁরা আসছেন, সব জবরদখল করে বসে পড়ছেন। সম্প্রতি রাজারহাটে ব্যক্তিগত কাজে গিয়েছিলেন মমতা।
এদিন সেই অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে গিয়ে তিনি বলেন, “ওয়েবেলের সামনে দিয়ে আসছিলাম। দেখি কালো কালো প্লাস্টিক খাটিয়ে বসে পড়েছে। সব আউটসাইডার।”
অবাঙালি জনসংখ্যা গত কয়েক বছরে সল্টলেক-বিধাননগরে বেড়েছে। নবান্নের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বৃদ্ধ বৃদ্ধারা ওখানে থাকেন। তাঁদের থেকে ভাড়া নিয়ে নিচ্ছে। তার পর কোনও অনুমতি না নিয়ে তিনতলা চারতলা পাঁচতলা তুলে দিচ্ছে। দু একটা ভাঙুন। তবে শিক্ষা হবে”।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন বুঝিয়ে দেন, বাইরের লোক বসানোর নেপথ্যে তৃণমূলের একাংশ কাউন্সিলর, পুরসভার কিছু অফিসার ও পুলিশের লোকজনের হাত রয়েছে। তাঁরা টাকা নিয়ে লোক বসাচ্ছেন। যা আর বরদাস্ত করা হবে না।
বৈঠকে মমতা বলেন, “রাজ্যের জমি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। আরে এত বাইরের লোক এলে আমি টানব কী করে? পাঁচটা রাজ্যকে টানব কী করে? আমাদের ঘাড়ের উপর দেখছি যত বোঝা!”
খুব তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “এর পর বাংলায় কথা বলার লোক খুঁজে পাবেন না”। তাঁর কথায়, “হিন্দি ভাষা ইংরেজি ভাষারও কদর রয়েছে। আমি সবাইকে বড় করেই দেখছি। কিন্তু এও মনে রাখতে হবে, সব রাজ্যের একটা সংস্কৃতি আছে। বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। অন্যদেরও সংস্কৃতি রয়েছে। আমাদের দেখতে হবে, অর্থের বিনিময়ে বাংলার আইডেনটিটি যেন নষ্ট না হয়। এটা কোনও ভাবেই মেনে নেব না”।
প্রশাসনিক কর্তাদের উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘‘আজকের আমার বলার দিন। আপনাদের শোনার দিন। কিন্তু এই কথাগুলো নেতিবাচক ভাবে নেবেন না কেউ। মানুষের কাজ করার কথা বলছি।’’