পার্থ সারথি নন্দী , দেশের সময়: সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কোনও দিন খাওয়া জোটে। কোনও দিন আবার সেটাও জোটে না। একটু ভাল থাকার আশায় স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই একশো দিনের কাজে গিয়েছিলেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাটি কাটার কাজ করেছিলেন।
ভেবেছিলেন, মজুরি পেলে হয়তো ঘরের অভাব খানিকটা ঘুচবে। কিন্তু কপাল মন্দ। কাজ করলেও জোটেনি মজুরি। হকের টাকা আটকে দেয় কেন্দ্র সরকার। এরইমধ্যে বনগাঁর ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়েতের খলিতপুর গ্রামের বাসিন্দা পূর্ণিমা অধিকারীর স্বামী সুব্রতর শরীরে বাসা বাঁধে অসুখ। প্রথমে হার্নিয়া। তারপর গলব্লাডারে স্টোন।
সঙ্গে ফ্যাটি লিভার। একশো দিনের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্ত্রী ও দুই মেয়ের মুখে নুন ভাত তুলে দিতে কিছুদিন ভ্যান চালান সুব্রত। কিন্তু শরীর দেয়নি। পেট্রাপোলে সপ্তাহে তিনদিন লোডিং আনলোডিংয়ের কাজ করেও সংসার টানার চেষ্টা চালিয়েছেন। রাজমিস্ত্রির জোগারের কাজ করেছেন। কিন্তু এসবে যা রোজগার হয়েছে, তা ঘুরিয়ে আনতে ফুরিয়ে গিয়েছে। সবই চলে গিয়েছে খাওয়ার পিছনে।
ডাক্তার দেখানোর আর পয়সা জোগাড় করতে পারেননি। তাই যেদিন শুনেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একশো দিনের কাজের বকেয়া মজুরি মিটিয়ে দেবে, সেদিন যেন একটা আশার আলো দেখেছিলেন পূর্ণিমা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোনওদিন সামনে থেকে দেখেননি তিনি। কিন্তু ছবি দেখেছেন। আর তাতেই কেমন যেন একটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। বললেন, আমি ঠিক জানতাম, দিদি যখন বলেছেন, আমাদের শ্রমের দাম দেবেন। কারণ, তিনি কথা দিলে কথা রাখেন।
আমার অ্যাকাউন্টে ছ’হাজার টাকা ঢুকেছে। স্বামীর অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে দশ হাজার। মোদী সরকার দু’বছর ধরে আমাদের হকের টাকা আটকে রেখে দিয়েছে। কিন্তু মমতা তা দিলেন। এতদিন পয়সার অভাবে ঘরের লোকটার চিকিৎসা করাতে পারিনি। রাতভর যন্ত্রণায় ছটফট করেছে লোকটা। শুধু অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা আর কিছুই করতে পারিনি। কখনও সখনও লোকজনের কথা শুনে টোটকা করেছি।গাছগাছালি নিয়ে এসে খাইয়েছি। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয়নি। যে টাকা পেয়েছি, তা দিয়ে আগে মানুষটাকে চিকিৎসা করাতে চাই।
কয়েকদিনের মধ্যেই কলকাতায় পিজি হাসপাতালে যাব। আর লোকটাকে কষ্ট পেতে দেব না। আমাদের জন্য সে কতটা পরিশ্রম করেছে, আমি ও আমার দুই মেয়ে নিজেদের চোখে দেখেছি। দিদি আমাদের বাঁচিয়ে দিলেন। পূর্ণিমার বড় মেয়ে বিএ পাশ করে এখন টিউশন করেন।
সময় পেয়ে সেলাইয়ের কাজ করেন বাড়িতে। বললেন, শরীরের জন্য বাবা এখন আর সেভাবে কাজ করতে পারেন না। তাই আমি আর মা কাজ করে কোনওমতে সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছি। বোন এবার মাধ্যমিক দিল। ওর পড়াশোনার খরচও রয়েছে। সবটা জুগিয়ে আর বাবাকে ডাক্তার দেখানোর পয়সা জোগাড় করতে পারছিলাম না।
মুখ্যমন্ত্রী একশো দিনের কাজের বকেয়া মজুরিটা দিয়ে আমাদের কত বড় যে উপকার করলেন, বলে বোঝাতে পারব না। এবার বাবাকে কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার মতো দু’টো পয়সা এল হাতে। মোদী সরকার গরিব মানুষের এই কষ্ট বুঝবে না। একশো দিনের কাজে দুর্নীতি হয়েছে কি না জানি না। তবে আমার বাবা-মা শ্রম দিয়েছেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাটি কেটেছেন। ওদের টাকাটাও দু’বছর ধরে দিল না কেন্দ্র সরকার। আসলে ওরা গরিব মানুষকে ভাতে মারার চেষ্টা করছে।
একইভাবে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন খলিতপুরের বাসিন্দা ঝর্ণা অধিকারী। স্বামী সঞ্জয় অধিকারী মারা গিয়েছেন। এক মেয়ে। তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ঝর্ণা বাড়িতে কয়েকটা ছাগল পোষেন। কৃষিজমিতে শ্রমিকের কাজ পেলে করেন। না হলে ভাইয়ের বাড়ি থেকে খাবার দিয়ে যায়। তা দিয়েই কোনও মতে পেট ভরান। নিজে উপার্জনের লক্ষ্যে একশো দিনের কাজ করেছিলেন ঝর্ণা। কিন্তু মজুরি না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। একটা দু’টো দিন তো নয়, দু’বছর। কোনওদিন আর ওই টাকা পাবেন, এমনটা আশাও করেননি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও অনেকের মতো তাঁর জীবনের সঙ্কটকালেও ত্রাতা হয়েই এলেন।
একে তো ঘরে পয়সা নেই। তার উপর কিছুদিন ধরে নার্ভের রোগ দেখা দিয়েছে ঝর্ণার। কোমড় থেকে পা পর্যন্ত শিরা শুকিয়ে যাচ্ছে। সারাক্ষণ অসহ্য যন্ত্রণা। এলাকায় একটা হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, বড় ডাক্তার দেখাতে হবে। না হলে কিছুদিন পর আর হাঁটতে পারবেন না। কিন্তু বড় ডাক্তার দেখাতে গেলে তো টাকা লাগবে। সেই টাকা পাবেন কোথায়! ফলে আর ডাক্তার দেখানো হয়নি। ধরেই নিয়েছিলেন, বিনা চিকিৎসায় এভাবে যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মারা যেতে হবে। কিন্তু দু’দিন আগেই একশো দিনের কাজের তাঁর শ্রমের দাম মিলেছে। রাজ্য সরকার তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ছ’হাজার টাকা দিয়েছে। ওই টাকা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা ঝর্ণা।
বললেন, এবার একটা বড় ডাক্তার দেখাতে পারব। হয়তো পা-টা ভাল হয়ে যাবে। যন্ত্রণা থাকবে না। শান্তিতে রাতে একটু ঘুমোতে পারব। যন্ত্রণার জন্য কতদিন ধরে যে রাতে ঘুমোতে পারি না। সারারাত বিছানায় দাপাদাপি করতে হয়।
ছয়ঘরিয়ার প্রাক্তন প্রধান তথা বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ প্রসেনজিৎ ঘোষ বলেন, ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়েত এলাকায় একশো দিনের কাজ প্রকল্পে ৫৫৩ জন উপভোক্তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ৩১ লক্ষ ১ হাজার ৬৬৭ টাকা ঢুকেছে। প্রায় সবাই টাকা পেয়ে গিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার গরিব মানুষের শ্রমের দাম দিয়েছেন। যে টাকা মেটানোর কথা কেন্দ্রের, সেটা রাজ্য মিটিয়েছে।বিজেপি শুধু লোক দেখানো কথা বলে। কিন্তু গরিব মানুষের কথা ভাবেন একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই, এটা আবারও প্রমাণিত হল।