ওঁ (নমঃ) আগচ্ছন্তু মে পিতরঃ ইমং গৃহ্নন্ত্বপোহঞ্জলিম।
পিতৃলোকের আহ্বান করে তৃপ্তিসাধনের উদ্দেশ্যে জলদান বহুযুগের রীতি। শাস্ত্রমতে তর্পণে তৃপ্ত হন প্রয়াত প্রিয়জন। শান্তি পায় তাঁদের পরলোকগত আত্মা। প্রেতলোকের কষ্ট ত্যাগ করে যেন স্বর্গলোক লাভ করেন প্রয়াত পূর্বপুরুষ। এই ইচ্ছা নিয়ে তাঁদের আত্মার উদ্দেশে জলদান হিন্দু মননে অতি পুণ্যকাজ।
অনেকেই বিশ্বাস করেন আত্মার বিনাশ নেই। তাই পূর্বপুরুষের আত্মার তৃপ্তির উদ্দেশে শ্রাদ্ধকাজ করা উত্তরাধিকারীদের কর্তব্য। তৃপ্তিদান ও তৃপ্তিলাভ – এটাই তর্পণের প্রধান লক্ষ্য। পূর্বপুরুষে আত্মা তৃপ্ত হলে উত্তরাধিকারীদের স্বাস্থ্য, আয়ু ও ধন বৃদ্ধি হয় বলে বিশ্বাস রয়েছে। আসে শান্তি । ওঁ (নমঃ) অগ্নিদগ্ধশ্চ যে জীবাঃ যেহপ্যদগ্ধা কুলে মম। ভূমৌ দক্তেন তৃপ্যন্তু তৃপ্তা যান্তু পরাং গতিম। অর্থ – আমার বংশে যে সকল জীব অগ্নিদ্বারা দগ্ধ হয়েছেন, অর্থাৎ যাঁদের দাহ-সংস্কার হয়েছে এবং যাঁরা দগ্ধ হননি, অর্থাৎ কেউ তাঁদের দাহ-সংস্কার করেনি, তাঁরা তৃপ্তি লাভ করুন আমার এই জল গ্রহণ করে এবং পরাগতি অর্থাৎ স্বর্গলোক লাভ করুন।
পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ মহালয়া। আর এই মহালগ্নে উত্তরপুরুষের হাতের জলে পূর্বপূরুষ তৃপ্ত হলে তার থেকে ভাল আর কিছু হয় না বলেই বিশ্বাস। দেখুন ভিডিও
কুশ ও কালো তিল দরকার তর্পণে। যবও প্রয়োজন অনেক জায়গায়। কুশ বা তিল না পেলে শুধু জলের সাহায্যেও তর্পণ করা যায়। স্নান করার পর ভিজে কাপড়ে পূর্বমুখে নাভি পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে বা এক পা জলে এক পা ডাঙায় রেখে দাঁড়িয়েও তর্পণ করেন অনেকে। শুরু করার আগে কুশের আংটি বানিয়ে অনামিকা আঙুলে পরতে হবে।
তর্পণের ভাগ : শাস্ত্র বলে, পিতৃতর্পণের অধিকারী নন তাঁরা, যাঁদের বাবা বেঁচে আছেন। তর্পণের ভাগ রয়েছে । দেবতর্পণ, মনুষ্যতর্পণ, ঋষিতর্পণ, দিব্যপিতৃতর্পণ, যমতর্পণ, ভীষ্মতর্পণ, পিতৃতর্পণ। যদি কেউ সম্পূর্ণ তর্পণে অক্ষম হন, রাম-তর্পণ করতে পারেন। বিশ্বাস, বনবাসে থাকাকালীন শ্রীরামচন্দ্র এই তর্পণ করেছিলেন। রামতর্পণ সব তর্পণের ফল পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস। রামতর্পণে অসমর্থ হলে, লক্ষ্মণ তর্পণেও তর্পণ-ফল মেলে বলে বিশ্বাস। এছাড়া অগ্নিদগ্ধাদির তর্পণ, প্রেত তর্পণও রয়েছে।
আজ, শনিবার মহালয়া। এদিন ভোর থেকেই গঙ্গার ঘাটে ভিড় করেন তর্পণকারীরা।
পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি ঘাটেই আজ পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে জল পিণ্ড দান করা হচ্ছে।
মহালয়া কথাটি এসেছে ‘মহত্ আলয়’ থেকে।
পুরান অনুযায়ী ব্রহ্মা বলছেন যে পিতৃপুরুষেরা এই সময়ে পরলোক থেকে ইহলোকে আসেন জল ও পিণ্ডলাভের আশায়।
প্রয়াত পিতৃপুরুষদের জল-পিণ্ড প্রদান করে তাঁদের ‘তৃপ্ত’ করা হয় এই পূণ্য তিথিতে। এই পিণ্ড দান চলে মহালয়ার আগের ১৫ দিন থেকে অর্থাৎ এই মহালয়ার দিনটি হল অমাবস্যা ও পিতৃতর্পণের শেষ দিন।
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী অভুক্তকে আহার প্রদান করা হল শ্রেষ্ঠ দান।
কুন্তী পুত্র কর্ণ , যার আরেক নাম ছিলো দাতা কর্ণ, কারণ তিনি আজীবন দান করেছিলেন ধন, সোনা, রৌপ্য, ইত্যাদি।
মৃত্যুর পর কর্ণের আত্মা পরলোকে গমন করলে তাঁকে জম্ রাজ খাদ্য হিসেবে স্বর্ণ ও রত্ন দেওয়া হয়েছিলো। কারণ তিনি সারা জীবন স্বর্ণ ও রত্ন দান করেছেন, কিন্তু প্রয়াত পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কখনও খাদ্য বা পানীয় দান করেননি। তাই স্বর্গে খাদ্য হিসেবে তাঁকে সোনা দানা দেওয়া হয়েছিল।
প্রত্তুত্যরে কর্ণ জানান যে তাঁর পিতৃপুরুষের সম্বন্ধে তিনি তার মৃত্যুর মাত্র একদিন আগেই জানতে পেরেছেন তাই তিনি তর্পন করতে পারেন। তখন কর্ণকে ফের মর্ত্যে ফিরে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়।
তাই এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়। আর সেই থেকেই হিন্দুদের মধ্যে তর্পণের প্রথা সূচনা হয় ৷