দেশের সময় : সকাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টিকার, মেসেজের বন্যা। তাতে লেখা ‘শুভ মহালয়া’। কিন্তু মহালয়া যে শুভ নয়, তা অনেকেই জানেন না। এটা মোটেই কোনও সেলিব্রেশনের দিন যেমন নয়, তেমনই মহালয়ার সঙ্গে দেবীর আবাহনেরও কোনও সম্পর্ক নেই।
তবে এক অর্থে মহালয়া শুভ, সেটা শ্রাদ্ধকার্যের জন্য। এই দিন প্রয়াত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে শ্রাদ্ধ করার নিয়ম। অনেকে করেন। বেশিরভাগই করেন না। তাঁরা তর্পণ করেন। কিন্তু তর্পণ শ্রাদ্ধের একটি অংশ মাত্র।
তর্পণ অর্থাৎ তৃপ্ত করা। মহালয়ায় যে তর্পণ করা হয়, তা কিন্তু একদিনের বিষয় নয়। গোটা পিতৃপক্ষ অর্থাৎ মহালয়ার আগের ১৪ দিন ধরে এই পর্ব চলে। শেষ তর্পণ হয় মহালয়ার অমাবস্যায়।
কেন মহালয়াতেই তর্পণ করা হয়? পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলছেন, কারও বাবা-মা মারা গেলে কোনও সন্তান যদি প্রবাসে থাকার কারণে শ্রাদ্ধের দিন এসে না পৌঁছতে পারেন কিংবা তিনি যদি কোনও কারণে পিতৃশ্রাদ্ধ করতে না পারেন, তাহলে পুরোহিত বিধান দেন, পরের অমাবস্যায় সেই ব্যক্তি শ্রাদ্ধকার্য করতে পারেন। অর্থাৎ অমাবস্যা হল, শ্রাদ্ধের একটা শুভক্ষণ। সেই হিসেবে শ্রাদ্ধকার্যের জন্য মহালয়া শুভ হতে পারে, অন্য কোনও কারণে নয়।
মহালয়া নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। কর্ণ দাতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের হাতে তাঁর যখন মৃত্যু হয় এবং পিতৃলোকে তাঁর স্থান হয়, তখন দেবরাজ ইন্দ্র ওরফে যমরাজ কর্ণকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। অভ্যর্থনা পর্ব শেষ হওয়ার পর কর্ণের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তাঁকে থালায় করে খেতে দেওয়া হয় সোনা, রুপো, হীরে, মোতি। যা দেখে কর্ণ দেবরাজকে প্রশ্ন করেন, আমি তো শুনেছি, দেবলোকে অনেক ভালোমন্দ খাবারের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে আমাকে এসব খেতে দেওয়া হচ্ছে কেন? উত্তরে দেবরাজ কর্ণকে বলেন, তুমি তো সারাজীবন ব্রাহ্মণদের এসবই দান করেছো। কাউকে অন্ন-পান দাওনি। পিতৃপুরুষের উদ্দেশে পিণ্ডদান করোনি। তাহলে পিতৃলোকে এসে তুমি খাবার পাবে কী করে? এরপর নাকি দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশে পনেরো দিনের জন্য কর্ণ ফের মর্ত্যে আসেন। এবং পিতৃপুরুষের উদ্দেশে পিণ্ডদান করেন। তারপর আবার ফিরে যান দেবলোকে।
যে ১৫ দিন ধরে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে কর্ণ মর্ত্যে পিণ্ডদান করেছিলেন, সেই পক্ষকালকে পিতৃপক্ষ বলে চিহ্নিত করা হয়।
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলছেন, আমাদের মর্ত্যের একবছর মানে পিতৃলোকের একদিন। অর্থাৎ প্রয়াত পিতৃপুরুষের উদ্দেশে আমরা বাৎসরিক করে থাকি, সেটাকে সপিণ্ডকরণ বলে। ওই পিণ্ডে পিতৃলোকে থাকা পূর্বপুরুষের একদিনের খাবার জোগাড় হয়। সেই হিসেবে প্রতিবছরই সপিণ্ডকরণ করা উচিত। তাহলেই পিতৃলোকে থাকা পূর্বপুরুষদের খাবার জোগাড় হয়। এছাড়া উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, বিয়ের নান্দীমুখ শ্রাদ্ধে যে পিণ্ড দান করা হয়, তাতে বাড়তি খাবার জোগাড় হয় পিতৃলোকে থাকা পূর্বপুরুষদের।
মহালয়া মানে মহান আলয়। এই জগতের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা। তারই অপর নাম মহান। এই মহান থেকেই বুদ্ধি, অহংকার সবেরই সৃষ্টি। বলা হয়, মানুষের মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে সমস্ত ইন্দ্রিয় একে একে মহান অর্থাৎ বুদ্ধি অর্থাৎ ব্রেনে এসে মিলিত হয়। এবং একেবারে শেষে বুদ্ধির অর্থাৎ ব্রেনের মৃত্যু ঘটে। আমাদের বিশ্বাস, মহালয়া তিথিতে পিতৃলোকে থাকা পূর্বপুরুষরা কিছুটা নীচে নেমে আসেন, যাতে আমরা যে তাদের উদ্দেশে তিল-জল তর্পণ করি, তারা তা সহজেই গ্রহণ করতে পারেন।
পিতৃলোক সম্পর্কে অবশ্য একটা অলৌকিক কল্পনা আছে। বলা হয়, আমাদের প্রয়াত পূর্বপুরুষদের মধ্যে শুধুমাত্র শেষে তিনটি জেনারেশনই পিতৃলোকে থাকেন। তার আগের সব জেনারেশনকে দেবলোকে পাঠিয়ে দেন যমরাজ।
এবার আসা যাক, মহালয়া থেকেই দেবী দুর্গার আবাহনী শুরু হয়ে যায় বলে একটা ধারণা আছে। এটাও একেবারে ভুল। মহালয়ার সঙ্গে দুর্গার আবাহনীর কোনও সম্পর্ক নেই। মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে আমরা যে মহিসাসুরমর্দিনী শুনি, সেটা মোটামুটি ১৯৩১ সাল থেকে হয়ে আসছে। তার আগে বাণীকুমার করতেন। তবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে এই অনুষ্ঠান প্রথমেই কিন্তু আকাশবাণীতে মহালয়ার ভোরে সম্প্রচারিত হয়নি। এনিয়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে। কখনও তা সম্প্রচার করা হয়েছে ষষ্ঠীর দিন। কখনও আবার তা সম্প্রচার করা হয়েছে পঞ্চমীতে।শেষে মহালয়ার ভোরে। মহালয়াতেই ওই অনুষ্ঠান ক্লিক করে যায়। এবং তা বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।
মনে রাখতে হবে, মহালয়া হল একটি তিথি। তিথি সংস্কৃত শব্দ। চান্দ্রমাস ধরে এই তিথি গণনা হয়। এই তিথি বিরহের তিথি। এই তিথিতে শুধু নিজের পিতৃপুরুষের উদ্দেশেই যে তর্পণ করা হয়, তা কিন্তু নয়। বলা হয়, নানা কাজেকর্মে ভীষ্ম বিয়ে করতে পারেননি। ফলে তাঁর সন্তানসন্তনি ছিল না। মহালয়ার ভোরে আমরা পিতামহ ভীষ্মের উদ্দেশেও তর্পণ করে থাকি। এবং সেখানে মন্ত্রে এটাই বলা হয়ে থাকে যে, তোমার উত্তরাধীকার থাকলে তাঁদের হাতে জল-তিল পেয়ে তুমি যেভাবে তৃপ্ত হতে, আমাদের হাত থেকে তা গ্রহণ করে একইভাবে তৃপ্তিলাভ করো তুমি।
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলছেন, প্রয়াত পিতৃপুরুষের উদ্দেশে প্রতিদিনই তর্পণ করার নিয়ম আমাদের। কিন্তু আমরা তা পারি না। তাই মহালয়ার ভোরে তর্পণের মধ্যে দিয়ে সর্বসিদ্ধি লাভের চেষ্টা করি আমরা। এই মাহেন্দ্রক্ষণ একেবারেই আবাহনীর সূচনা নয়। বরং বলা যেতে পারে, এটি পিতৃপুরুষের মহোৎসবের দিন।