দেশের সময়,অশোকনগর :গত কয়েকদিন ধরে ছেলেধরা আতঙ্ক উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলির একাধিক জায়গায়। বাচ্চাদের নিয়ে উদ্বেগে পরিবারের লোকেরা। সতর্ক থাকতে বলছে স্কুলগুলিও। বাড়িতে যাদের বাচ্চা রয়েছে, তারা উদ্বিগ্ন থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই উদ্বেগের ফল কোথাও কোথাও সাংঘাতিক আকার নিচ্ছে। আবারও ছেলেধরা সন্দেহে এক তরুণীকে গণপিটুনি দিল এলাকার লোকজন। কিছুদিন আগেই বারাসতে যে ছবি দেখা গিয়েছিল। এবার তারই পুনরাবৃত্তি অশোকনগরে। শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামপঞ্চায়েতের পুমলিয়ায় বেধড়ক মার খেলেন ২৮ বছরের এক তরুণী। উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশও আক্রান্ত হয় বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে খবর, আহতের নাম রজনী খাতুন। ২৮ বছরের রজনীর বাড়ি ডায়মন্ড হারবার এলাকায়। সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান তিনি। পুলিশ সূত্রে খবর, বিকেলে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কিছুটা মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন ওই তরুণী। তাঁকে দেখে সন্দেহ কয়েক জন স্থানীয়ের। অভিযোগ, বিনা প্ররোচনায় শুরু হয় ওই তরুণীকে মার। কয়েক’শো মানুষ ঘিরে ধরেন একা ওই তরুণীকে।
শুক্রবার বিকালে পুমলিয়ায় চলে আসেন তিনি। এদিকে অচেনা মুখ দেখে এলাকার লোকজন সন্দেহ করেন। এরপরই কয়েকশো মানুষ ঘিরে ধরে তাঁকে। শুরু হয় বেধড়ক মার।
এদিকে ততক্ষণে অশোকনগর থানায় খবর চলে যায়। পুলিশের দল গিয়ে হাজির হয় ঘটনাস্থলে। তবে এত লোকের মাঝে তরুণীকে উদ্ধার করতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। অশোকনগর কল্যাণগড় পুরসভার চেয়ারম্যান প্রবোধ সরকার জানান, এসআই মানিক মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন সেখানে। জনতার ঠেলাঠেলিতে তিনি কার্যত পড়ে যান মাটিতে। পরে ওসি চিন্তামণি নস্করের উদ্যোগে পুলিশের বিশাল বাহিনী গিয়ে গ্রামে পৌঁছয়। এই ঘটনায় ৫ জনকে আটকও করা হয়।
বারাসত পুলিশ জেলার সুপার প্রতীক্ষা ঝারখারিয়া জানিয়েছেন, শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ ছেলেধরা সন্দেহে জনৈক রজনী খাতুনকে মারধর করার খবর পায় পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকাজে যায় পুলিশ। পাঁচ জনকে এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার করেছে। ইতিমধ্যে মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হয়েছে।
অশোকনগর কল্যাণগড় পুরসভার চেয়ারম্যান প্রবোধ সরকার বলেন, “ডায়মন্ড হারবার থেকে আজ বিকালে একটি মেয়ে পুমলিয়াতে চলে এসেছিলেন। কীভাবে এলেন জানা নেই। পুমলিয়ার কয়েকজন ছেলেধরা সন্দেহে মারধর শুরু করে। তাঁর প্রাণহানি হতে পারত। তবে পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। পুলিশ বাঁচাতে গিয়ে জনতার ধাক্কায় পড়েও যান। কিন্তু পুলিশ তৎপর না হলে মেয়েটিকে হয়ত বাঁচানোই যেত না। আমার একটাই অনুরোধ, আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। পুলিশকে জানান। থানা সবসময় আপনাদের পাশে রয়েছে।”
ছেলেধরা সন্দেহে এই গণপিটুনির প্রবণতার শুরু বারাসতের কাজিপাড়ায় এক বালককে খুনের ঘটনা দিয়ে। কেউ বা কারা ওই বালককে হত্যা করা পর গুজব রটে যায় যে, ছেলেধরার খপ্পরে পড়েছিল ছেলেটি। ছেলেধরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে চোখ উপড়ে, কিডনি বার করে খুন করেছে। ঝুলন্ত অবস্থায় বালকের দেহ মেলে। যদিও পুলিশ জানায়, ময়নাতদন্তে এমন কোনও ঘটনার প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু ওই খুনের ঘটনার পর থেকেই সমাজমাধ্যমে ঘুরতে শুরু করে বারাসতের ছেলেধরার কাহিনি। বলা হয়, বারাসতে ছেলেধরার দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছে। বারাসতের বলে অন্য বিভিন্ন জায়গার ভিডিয়োও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই ভিডিয়োগুলির সত্যতা যাচাই করেনি দেশের সময় ।
উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে বারাসতের কাজিপাড়ায় একটি শিশুর দেহ উদ্ধার হয়। তারপর থেকেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে শিশুচুরির গুজব। সোশ্যাল মিডিয়ায়েতও এই সংক্রান্ত পোস্ট ভাইরাল হয়। বুধবার শিশুচোর সন্দেহে ৩ জনকে বেধড়ক মারধর করে উত্তেজিত জনতা। গুরুতর আহতর অবস্থায় ওই ৩ জনকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। আহতদের মধ্যে মহিলাও রয়েছেন। এমনকী পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে জনতার রোষের মুখে পড়ে পুলিশও। এরপরেই বিষয়টিতে আরও বেশি করে তৎপর হয় পুলিশ প্রশাসন।
এই গুজব এবং সমাজমাধ্যমে ‘অপপ্রচারের’ কারণে বুধবারই তিন জন সন্দেহের বশে গণধোলাই খান। তদন্তে নেমে পুলিশ প্রথমেই ছেলেধরা-তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছিল। দুই এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখেছে পুলিশ। গণপিটুনি যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের বেশ কয়েক জনকে চিহ্নিত করা গিয়েছে। অন্তত ১৭ জনকে গ্রেফতারের খবর মিলেছে।