সোমবার ভোট গ্রহণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর ও তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস ঘুরে বেড়ালেন গোটা এলাকায়। কখনও বা একই এলাকায় একাধিক বার।
কোন গুলির শব্দ শোনা গেলনা ,বোমা পড়ল না, এমনকি, এক ফোঁটা রক্তও ঝরেনি! অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি! পঞ্চম দফায় মোটের উপরে শান্তিতেই মিটেছে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের ভোটপর্ব। বিক্ষিপ্ত গন্ডগোলের অভিযোগ এলেও যেমনটা আশঙ্কা করা হচ্ছিল, সেই তুলনায় প্রায় কিছুই ঘটেনি।
এমন ঘটনাবিহীন নির্বাচন শেষ কবে হয়েছে, তা মনে করতে কার্যত স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন ব্নগাঁ-বাগদা সীমান্তঅঞ্চলের বাসিন্দারা। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মতুয়া ভোটার অধ্যুষিত এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ১৮ লাখ ৩৬ হাজার ৩৭৪। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৮৪। মহিলা ভোটার ৯ লাখ ১ হাজার ৪১৯। আর তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৭১। মোট পোলিং স্টেশন ১,৯৩০। তার মধ্যে ক্রিটিক্যাল পোলিং স্টেশন ৫৫০।
বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে স্বীকৃত রাজনৈতিক দল, নির্দল মিলিয়ে মোট ১৫ জন প্রার্থী এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর সঙ্গে নোটা রয়েছে একটি। এই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস এবং বিজেপির প্রার্থী শান্তনু ঠাকুরের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বি। সঙ্গে রয়েছেন বাম–কংগ্রেস জোট প্রার্থী প্রদীপ বিশ্বাস।
এই কেন্দ্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভোটপর্ব মিটতে রাত হলেও প্রায় ৭৬ শতাংশ ভোট পড়েছে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।
২০মে সোমবার ভোট গ্রহণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর ও তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস এবং বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী প্রদীপ বিশ্বাস। ঘুরে বেড়ালেন গোটা এলাকায়। কখনও বা একই এলাকায় একাধিক বার।
এই কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকায় শান্তনুকে দেখা গেল চেনা ছন্দে, প্রতিবাদীর ভূমিকায়। ইভিএম বিকল হওয়া থেকে শুরু করে এজেন্টকে বার করে দেওয়া, ভোটারদের ভয় দেখানো ও মারধর-সহ ভোট বানচালের চেষ্টার ভূরি ভূরি অভিযোগ নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন শান্তনু। বিশ্বজিৎ বলেছেন, ‘‘এ ছাড়া আর কী-ই বা বলবে? অভিযোগ হাজারটা থাকতে পারে। কিন্তু সেগুলির সত্যতা থাকতে হবে তো।’’
সকালে চড়া রোদ থাকলেও বেলা বাড়তেই আকাশ কালো হয়ে এসেছিল। মেঘ ডেকে প্রবল বৃষ্টি
নামল সওয়া ১১টা নাগাদ। বৃষ্টি থমকে দিল ভোটের গতি। ভোট দিতে যাওয়া অনেকেই বাড়িমুখো হলেন। অনেকে আশ্রয় নিলেন কোনও ছাউনির নীচে। বৃষ্টিতে বহু বুথে জল দাঁড়িয়ে গেল। যাঁরা ভোটের লাইনে ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ ভোট দিলেন জলে পা ডুবিয়েই, কেউ আবার বৃষ্টি থামলে পুনরায় এসে ভোট দেবেন বলে চলে গেলেন। সব চেয়ে বেশি নাজেহাল হতে হল বয়স্ক ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের।
এদিন নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে সকাল সকাল ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছিলেন ৯৫ বছরের তারাপদ কর্মকার। ভোট কেন্দ্রে ঢুকে আঙ্গুলে ভোটের কালি লাগানোর কাজও শেষ হয়।
কিন্তু তারপরই ভোট না দিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে ফিরে আসতে হল ওই বৃদ্ধকে। কারণ হিসেবে প্রিসাইডিং অফিসার জানিয়ে দেন, তাঁর নাম নাকি ভোটার তালিকা থেকে কেটে গেছে।
অবাক করা এই কান্ড ঘটেছে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের ছয়ঘড়িয়া ঠাকুর হরিদাস বালিকা বিদ্যালয়ের ১৫২ নম্বর বুথে। বৃদ্ধ তারাপদ কর্মকার জানান, ‘ভোট দিতে গিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করার পর আঙুলে কালি লাগিয়ে দেওয়ার কাজ শেষ হয়। এরপর যখন ভোট দিতে যাবো তখন জানানো হয়, ভোটার লিস্ট থেকে আমার নাম কাটা গেছে।’এই ঘটনায় রীতিমত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ওই বৃদ্ধ পাশাপাশি চিন্তিত হয়ে পড়েন। তারাপদবাবুর অভিযোগ, আমি বেঁচে থাকতেও আমার নাম কিভাবে কাটা গেল গত পঞ্চায়েত ভোটেও ভোট দিয়েছেন। ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করার পর আঙ্গুলে কালি লাগানোর পর ভোট না দিতে পারার ঘটনায় নির্বাচন দপ্তরের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই বিষয়ে দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং অফিসারের সাথে কথা বলতে চাইলে ক্যামেরার সামনে তিনি কোন রকম মন্তব্য করতে চাননি। যদিও এটি একটি ভুল বলে স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন বলে জানান।
বেলা শেষে ১,৯৩০টি ভোট কেন্দ্রের অধিকাংশ বুথে ভোটের লম্বা লাইন পড়ল। নির্ধারিত সময় ছাড়িয়েও ভোট চলল রাত পর্যন্ত।
বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান গোপাল শেঠ বলেন, ‘‘বনগাঁর লোকসভা ভোট হয়েছে শান্তিপূর্ণ ভাবে। আমরা হিংসাত্মক কিছু ঘটতে দেব না বলেছিলাম, কথা রাখতে পেরেছি।’’ চেয়ারম্যানের কথার প্রমাণ মিলেছে ব্নগাঁয় ভোটের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক শীর্ষ কর্তাকে দেখে। এ দিন তিনি ইছামতির ধারে একটি অতিথিশালায় ছুটি কাটানোর আমেজে ছিলেন।
এদিন সকালে গোপালনগরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বুথে ভোট দেন তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস। ভোট দিয়ে সাংবাদিকদের তিনি জানান, ‘বনগাঁতে শান্তুপূর্ণভাবে ভোট হবে। উৎসবের মেজাজে মানুষ ভোট দিচ্ছেন।’
অন্যদিকে, ঠাকুরবাড়ির মন্দিরে প্রণাম করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে লাইন দিয়ে ভোট দিলেন বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর। ভোট দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শান্তনু ঠাকুর বলেন, ‘আমাকে হারানোর জন্য মমতা ঠাকুর ভেক ধরেছেন। তাতে কোনও লাভ হবে না।’
দিন শেষে অবশ্য বিশ্বজিৎ বললেন, ‘‘এ লড়াই মানুষের জন্য। ভোটে জিতে প্রমাণ করব।’’ আর শান্তনু বললেন, “মানুষ ভোট দিয়েছেন স্বত:স্ফূর্ত ভাবে। জয়-পরাজয় তো পরের কথা। কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো তাই নির্বিঘ্নে ভোট হয়েছে, মানুষ তাঁদের অধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন । মোদীজিকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করতে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে বিপুল সংখ্যক পদ্ম ফুল ফুটিয়েছেন যা দেখা যাবে আগামী ৪জুন ।’’
ছবিগুলি তুলেছেন রতন সিনহা ও দেবানন্দ পাইন ।