দেশের সময়: সব তীর্থ বারবার। গঙ্গাসাগর একবার।এই প্রবাদবাক্যকে মাথায় রেখেই মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগরে উপচে পড়ল ভক্তদের ঢল। শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৩ মিনিটে শুরু হয়েছে মকরস্নানের পুণ্যলগ্ন। চলবে রবিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৩ মিনিট পর্যন্ত। গোটা দেশ থেকে পুণ্যার্থীরা ভিড় জমিয়েছেন সাগরে। এসেছেন বিদেশ থেকেও।

নানা মুখ। নানা অভিব্যাক্তি।পুণ্যলাভের আশায় হাজার হাজার মাইল দূর থেকে এসেছেন ভক্তরা। এসেছেন সন্ন্যাসী কিংবা অতিথি। সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।

জনজোয়ার দেখে প্রশাসনের অনুমান, সর্বকালীন রেকর্ড গড়বে এবারের গঙ্গাসাগর।গত শুক্রবারই সাগরে ৩১ লক্ষ পুণ্যার্থী স্নান সেরেছেন বলে দাবি করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। তার পরের দু’দিন ভিড়ের মাত্রা বেড়েছে কয়েকগুণ।সবমিলিয়ে এবার পুণ্যার্থীর সংখ্যা ৫০ লক্ষ অনায়াসেই পার করে যাবে বলে মনে করছে রাজ্য প্রশাসন।

মেলার ষষ্ঠ দিনে গঙ্গাসাগরে হাজির ছিলেন পুরীর শঙ্করাচার্য স্বামী নিশ্চলানন্দ সরস্বতী মহারাজ। প্রতি বছরের মতো এবারও তিনি ভক্তদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। পরে সাংবাদিক বৈঠক করেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই গঙ্গাসাগর মেলাকে জাতীয় মেলার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। সেই দাবিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন শঙ্করাচার্য। তাঁর কথায়, তীর্থের শুদ্ধতা বজায় রেখে যা করার তাই করতে হবে। বাংলায় পুরীর মতো মন্দির তৈরির যে কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, এ জন্য মুখ্যন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন শঙ্করাচার্য। যোশিমঠ নিয়ে মুখ খোলেন তিনি। বলেন, যোশিমঠ থেকে বদ্রিনাথ হেঁটে গেলে বেশি পুণ্য মেলে। গাড়িতে কম। হেলিকপ্টারে গেলে আরও কম। তাই পাহাড় কেটে সর্বত্র রাস্তা করার বিরোধী আমরা। এটা প্রকৃতি বিরোধী কাজ। আমাদের চোখ, নাক, মুখে ছিদ্র দিয়েছেন ভগবান। সবটা ভরাট করে দিলে সমতল হয়ে যাবে। সব ইন্দ্রিয় নষ্ট হয়ে যাবে। পাহাড়ও একইভাবে প্রকৃতির সৃষ্টি। সে উঁচুনিচু।তাকে জোর করে সমতল করার চেষ্টা করলে তার ফল ভাল হবে না। শঙ্করাচার্যের মতে, পাহাড় কেটে সভ্যতার বিকাশ মোটেই ঠিক নয়। বিকাশ শব্দের অর্থ ব্যক্তি ও বস্তুর উন্নয়ন। তা না করে বিকাশের নামে বিস্ফোরণ ঘটালে, প্রকৃতি তার শোধ তুলবেই। তবে তাঁর মতে, যোশিমঠে এখন যা পরিস্থিতি, তাতে উপহাস, সমালোচনার সময় নয়। সরকার যা করছে তাতে সহযোগিতা করতে হবে।

শনিবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়েছিল স্নানের পুণ্যলগ্ন।ফলে স্নানের জন্য গোটা রাত পেয়েছেন পুণ্যার্থীরা। আর একারণেই বাড়তি সতর্ক ছিল প্রশাসন। রাতে সাগরে স্নানে নেমে যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেজন্যই বাড়তি নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়। অনেকেরই বিশ্বাস, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে স্নান করলে সবচেয়ে বেশি পুণ্য লাভ হয়। সেইমতো যাতে মাহেন্দ্রক্ষণ পেরিয়ে না যায়, সেজন্য শনিবার বহু মানুষ সাগরের পাড়ে অপেক্ষা করেছেন রাতভর। ভোর হতেই তাঁরা সাগরে নেমে পড়েন। 

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে, শনিবার সূর্যোদয় থেকে সন্ধ্যা ৭টা ২৩ পর্যন্ত মকর সংক্রান্তির তিথি রয়েছে।পুণ্যস্নানের শুভ সময় সকাল ৭টা ১৩ মিনিট থেকে ১টা ৬ পর্যন্ত। গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা মতে, রবিবার মকর সংক্রান্তি।সূর্যোদয় থেকে সকাল ১১টা ৪৫ পর্যন্ত স্নানের জন্য শুভক্ষণ। 

পুরাণে রয়েছে, সগর রাজার ৬০ হাজার সন্তানকে জীবন ফিরিয়ে দিতে ভগীরথ মর্তলোকে গঙ্গাকে নিয়ে এসেছিলেন। তাই মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গা ও সাগরের সঙ্গমে স্নান করলে অসীম পুণ্য হয়।   

তবে সাগরের পুণ্যার্থীদের এবার মন খারাপ ছিল, সাগরের ২ নম্বর বিচে স্নান করতে না পেরে। বেশিরভাগ ভক্ত এই বিচেই স্নান করতে পছন্দ করেন। কারণ, এখানে স্নান সেরে সোজাসুজি কপিলমুনির মন্দিরের গেটে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু এবার সেই সুযোগ ছিল না। প্রকৃতির রোষে এই সমুদ্রতট বিধস্ত হয়ে গিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও তার চেহারা ফেরানো যায়নি। সেকারণে এবার ওই বিচে স্নান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২ নম্বর বিচ থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে স্নান সারতে হচ্ছে পুণ্যার্থীদের। 

রাজ্য প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, এবার গঙ্গাসাগরে অতিরিক্ত ৩৩টি হাইমাস্ট আলো বসানো হয়েছে। ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে ৯০টি। বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তায়। সাগরে কোনও পুণ্যার্থী অসুস্থ হলে তাঁকে যাতে দ্রুত কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি করা যায়, সেজন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এয়ার লিফটের। ইতিমধ্যেই দুই পুণ্যার্থীকে এয়ার লিফট করিয়ে কলকাতার হাসপাতালে আনা হয়েছে।তাঁদের মধ্যে একজন নেপালের বাসিন্দা। গঙ্গাসাগর মেলায় আসার পথে শুক্রবার সন্ধ্যায় অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয় এক পুণ্যার্থীর। মৃতের নাম রামপরি দেবী (৭০)। বিহারের বাসিন্দা তিনি। নামখানার ২ নম্বর অস্থায়ী জেটি থেকে গঙ্গাসাগরে আসার জন্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জেটিতে উঠছিলেন তিনি। সেসময় অসুস্থ বোধ করেন।কর্তব্যরত পুলিশ কর্মীরা তাঁকে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। 

শুক্রবার গঙ্গাসাগরের গোটা ব্যবস্থাপনা পরিদর্শন করেন রাজ্যের পাঁচ মন্ত্রী।বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ছাড়াও ছিলেন পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী, দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু, জনস্বাস্থ্য ও কারিগরী মন্ত্রী পুলক রায়। যাঁরা এবার গঙ্গাসাগরে হাজির হতে পারেননি, তাঁরাও যাতে বাড়ি বসে পুণ্যস্নান দেখতে পারেন, সেজন্য ই-দর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশাসনের দাবি, অন্তত ৪০ লক্ষ মানুষ ই-দর্শনের মাধ্যমে বাড়ি বসে মকর সংক্রান্তিতে সাগরের স্নান দেখেছেন। এই সংখ্যা আরও অনেকটাই বাড়বে।অন্যদিকে, এবার অনলাইনে পুজো দেওয়ারও ব্যবস্থা ছিল। সাড়ে দশ লক্ষ পুণ্যার্থী ইতিমধ্যেই সাগরে কপিলমুণির মন্দিরে পুজো দিয়েছেন। সাগরে না গিয়েও বাড়ি বসেই মিলবে সাগরের পবিত্র জল ও প্রসাদ। শুধু একটি স্মার্ট ফোন থাকলেই হল। গঙ্গাসাগর মেলার ওয়েবসাইটে গিয়ে ই-স্নানের জন্য বুকিং করতে হবে।তাহলেই ভক্তের বাড়িতে পৌঁছে যাবে একটি বাক্স। সেই বাক্সের মধ্যে থাকবে পিতলের পাত্রে গঙ্গাজল, প্রসাদের প্যাড়া, পবিত্র সিঁদুর ও একটি পুস্তিকা। বাক্স প্রতি খরচ করতে হবে সাড়ে সাতশো টাকা। অর্ডারের পাঁচ থেকে সাতদিনের মধ্যে ডেলিভারি করা হবে। 

মন্দির চত্বরে পুজোর সরঞ্জামের ১৩০টি স্থায়ী দোকান রয়েছে। করোনার সময় অনেকেই সেই দোকান বন্ধ করে দিয়ে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। এবার মেলাকে কেন্দ্র করে তাঁরা ফের পুরনো পেশায় ফিরে এসেছেন। সাগরে এবার এতটাই ভিড় হয়েছে যে, অস্থায়ী ছাউনিগুলিতে তিল ধারণের জায়গা নেই।সমুদ্রতটে রাত কাটাচ্ছেন বহু মানুষ। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে।তারই মধ্যে তিন ও চার নম্বর বিচে প্লাস্টিক পেতে শুয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে বহু পুণ্যার্থীকে। জোয়ারের জল বাড়লে বিপদ হতে পারে।সেজন্য বারবার মাইকে সজাগ করা হয়েছে তাঁদের।বাহারি আলোয় সাজানো হয়েছে সাগরের পাড়।জলপথের পাশাপাশি নজরদারি চলছে আকাশপথেও।

এ বছর কুম্ভ মেলা না থাকায় গঙ্গাসাগরে যেন তিল ধারণের জায়গা নেই। মিনি ভারতবর্ষে পরিণত হয়েছে মেলা প্রাঙ্গন। লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে ভিন রাজ্য থেকে সাগরে আসা পুণ্যার্থীরা কীভাবে চিনবেন মেলার পথ। সেকথা মাথায় রেখেই বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি মেলার গেটে রয়েছে নম্বর। সঙ্গে বিভিন্ন পশুপাখির ছবি। সেই ছবি থেকে ভক্তরা চিনে নিচ্ছেন কোনটি কোন ঘাট। পুণ্যার্থীদের জন্য সাগরে এবার পাঁচটি অস্থায়ী ঘাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এবারের সাগর মেলায় দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের নয়া উদ্যোগ ‘বন্ধন’।পুণ্যার্থীদের ছবি সহ রাজ্য সরকারের ধন্যবাদ জ্ঞাপন সার্টিফিকেট প্রদান কর্মসূচি।যা দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে।বাবুঘাট ও গঙ্গাসাগর মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত ওই শংসাপত্র সংগ্রহ করেছেন প্রায় আড়াই লক্ষ পুণ্যার্থী। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়। ফলে সাগরের পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রেখেছে গঙ্গাসাগর-বকখালি উন্নয়ন পর্ষদ। একাজে এগিয়ে এসেছে সাগর পঞ্চায়েত সমিতি। সাগরের পাড়ে ও মেলার মাঠে প্লাস্টিক দূষণ রোধ করতে বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। খোদ জেলাশাসক সুমিত গুপ্ত প্লাস্টিক মুক্ত কর্মসূচিতে অংশ নেন। শুধু প্লাস্টিক মুক্ত কর্মসূচি পালনই নয়, গঙ্গাসাগর মেলায় কারও হাতে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ দেখা গেলে তাঁর হাত থেকে সেটি নিয়ে কাপড়ের ব্যাগ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় এবার বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল গঙ্গাসাগর মেলায়। ১৩৬টি অস্থায়ী সাব স্টেশনের জিআইএস ম্যাপিং করা হয়।এই প্রযুক্তির সাহায্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনও ত্রুটি ধরা পড়লে ততক্ষণাৎ সংশ্লিষ্ট সাবস্টেশনের অবস্থান চিহ্নিত করা যাবে। সাব স্টেশনগুলিতে নজরদারির জন্য বসানো হয়েছে ৭০টি সিসি ক্যামেরা।

গত মঙ্গলবার উদ্বোধন হয় এবারের গঙ্গাসাগর মেলার।উদ্বোধন করেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক সুমিত গুপ্ত। ছিলেন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী বঙ্কিম হাজরা। গত দু’বছর করোনার দাপট ছিল।ফলে সাগর মেলা সেভাবে জমেনি। এবার যেন ভিড় পুষিয়ে দিয়েছে যাবতীয় আক্ষেপ। মেলা উপলক্ষে ২২৫০টি সরকারি ও ৫০০টি বেসরকারি বাসের ব্যবস্থা করেছিল রাজ্য সরকার।জলপথে পরিষেবা দিয়েছে ৪টি বার্জ, ৩২টি ভেসেল এবং ১০০টি লঞ্চ। নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে মোতায়েন করা হয় ১০টি অস্থায়ী দমকল কেন্দ্র। ছিল দমকলের ২৫টি ইঞ্জিন। কলকাতার বাবুঘাট থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত বসানো হয়েছে ১১০০ সিসি ক্যামেরা। ড্রোনের সাহায্যে আকাশপথে ও স্পিড বোটে জলপথে নজরদারি চালানো হয়েছে সারাক্ষণ। ১২, ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি সমুদ্র আরতির ব্যবস্থা করা হয়। মেলায় কোন দোকানে কেমন খাবার বিক্রি হচ্ছে, তার মান কেমন, ওই খাবার খেয়ে কোনও পুণ্যার্থী অসুস্থ হতে পারেন কি না, দেখার জন্য এবার খাবারের মান যাচাই করা হয়। এবার যাঁরা গঙ্গাসাগর মেলায় এসেছেন, তাঁদের জন্য রয়েছে পাঁচ লক্ষ টাকার বিমা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here