দেশের সময় : গঙ্গা সাগর: ঘড়ির কাঁটা ঠিক ১২ টা পেরতেই সমুদ্রে নামল পুণ্যার্থীদের ঢল। সকালের আলো ফোটার আগেই পুণ্যস্নান সারলেন বহু মানুষ। মধ্যরাত থেকেই শুরু হয়েছে মকর সংক্রান্তির স্নান। প্রতি বছরের মতো এবারও গঙ্গাসাগরে ছিল লক্ষাধিক মানুষের ভিড়। সোমবার সকালে সবাই স্নান সেরে পুজো দিতে যান কপিলমুনির আশ্রমে। মনে করা হচ্ছে এবারের ভিড় সর্বকালীন রেকর্ড তৈরি করবে। প্রশাসনের তরফে জানা গিয়েছে, রবিবার বিকেল পর্যন্ত ৬৫ লক্ষ পুণ্যার্থীর সমাগম হয়েছে মেলায়। এত বিপুল ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন।
কনকনে ঠান্ডায় যেন অমৃত সন্ধানে লক্ষপুণ্যার্থীরা। কৃচ্ছ্রসাধনেই হবে পুণ্য। সংক্রান্তির ঠান্ডা হাওয়া হাড় অবধি কাঁপিয়ে না দিলে ডুব দিয়ে আর লাভ কী! পুণ্যে খামতি থেকে যাবে না! বঞ্চিত করেনি সংক্রান্তির শীত।
কুয়াশা ঢাকা সাগরসঙ্গমে কালো কালো মাথার ভিড়। বহুবর্ণে রঙিন সাগরতট। জলে ডুবে পুণ্যস্নান সেরে নিচ্ছেন শয়ে শয়ে পুণ্যার্থী।
গতকাল রাত থেকে শুরু হয়েছে শুভক্ষণ। সোমবার ভোররাত থেকে চলছে পুণ্যস্নান। সাগরের ঠান্ডা হাওয়া শরীর ভেদ করে হাড়েও কাঁপুনি ধরাচ্ছে। কিন্তু কৌপিন পরিহিত সাধুসন্তদের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। কনকনে ঠান্ডা জলে অবগাহন করেই তাঁদের মুখে ফুটে উঠছে তৃপ্তির হাসি।
সোমবারের গঙ্গাসাগর দেখাল, পুণ্যের পথে যথেষ্ট যতই ক্লেশ, ততই যেন আনন্দ। পৌষসংক্রান্তির পুণ্যতিথিতে পুণ্য লাভের আশায় দশ থেকে আশি সকলেই ডুব দিচ্ছেন গঙ্গাসাগরে। হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে, বুক পর্যন্ত জলে নেমে সূর্যপ্রণাম সারছেন পুণ্যার্থীরা।
বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, বিহার থেকে শুরু করে এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে দল বেঁধে ভক্তেরা এসেছেন সাগরদ্বীপে।
এ বার গঙ্গাসাগরে পুণ্যস্নানের সময় রবিবার রাত ১২টা ১৩ থেকে সোমবার রাত ১২টা ১৩ পর্যন্ত। রবিবার থেকেই থিকথিকে ভিড় সাগর তটে। কপিল মুনির আশ্রম উপচে পড়ছে। রবিবার বেলা অবধি পরিসংখ্যাণ বলছে, প্রায় ৬৫ লাখ পুণ্যার্থীর ভিড় হয়েছে সাগরসঙ্গমে। স্নান সেরে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে উঠেও মুখে তৃপ্তির হাসি দেখা যাচ্ছে বৃদ্ধবৃদ্ধাদেরও।
সাগরমেলায় জনজোয়ার সামলাতে আগেভাগেই দারুণ ব্যবস্থা রেখেছে প্রশাসন। তীর্থযাত্রীদের থাকার জন্য এ বারে ‘বাফার জ়োন’ তৈরি করা হয়েছে। একইসঙ্গে কচুবেড়িয়া বাস স্ট্যান্ড এবং গঙ্গাসাগর বাস স্ট্যান্ড থেকে মেলা চত্বরে ১ থেকে ৫ নম্বর রাস্তা আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে।
এ বছর তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে করা হয়েছে ৬ নম্বর রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে তীর্থযাত্রীরা অনায়াসেই মকরস্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারবেন। ১১৫০টি সিসিটিভি, ২২টি ড্রোন, ১০টি স্যাটেলাইট ফোন ও ১৪০টি ম্যানপ্যাকের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি চালাচ্ছে পুলিশ। তৈরি হয়েছে পুলিশের মেগা কন্ট্রোলরুম। পুণ্যার্থীদের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখার জন্য ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালও তৈরি হয়েছে।
এবারে নতুন রঙের পোচ লেগেছে কপিল মুনির আশ্রমে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন সাজে এই মন্দির উদ্বোধন করেছেন। নতুন সাজ মানে, জয়পুরি পাথরে তৈরি বাসুকির ছাতার নীচে নৃসিংহ মুর্তি, পাশে রাধাকৃষ্ণ। পুরনো মূর্তি তিনটি। সিঁদুরলেপা লাল ভগীরথকে কোলে নিয়ে মকরবাহিনী গঙ্গা, পাশে যোগাসনে-বসা, পইতেধারী, শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত কপিল মুনি। আর এক পাশে প্রায় এক রকম দেখতে সগর রাজা।
এবছর রাত থেকেই সাগরতটে ছিল পুণ্যার্থীদের ভিড়। প্রদীপের আলো, ধূপ, ধুনোর গন্ধ আর শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনিতে ভরে ওঠে উপকূল। ভোর থেকে ঠাণ্ডার প্রকোপ কমলেও কুয়াশায় ছেয়ে গিয়েছে গোটা গঙ্গাসাগর।
কুয়াশার জেরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুণ্যার্থীদের যাতায়াতের বাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কুয়াশা কাটলে তবে পুনরায় পরিবহন ব্যবস্থা চালু হবে বলে জানানো হয়েছে।
ভেসেল চলাচলের ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে। মেলার মাঠ, কচুবেড়িয়া ও কাকদ্বীপ ভিড়ে ঠাসা। সোমবার দিনভর পুণ্যার্থীদের যাওয়া আসা চলবে। এদিন মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে শাহি স্নান। তাই পরিষেবা স্বাভাবিক না হলে সমস্যায় পড়তে হবে যাত্রীদের।
ঘন কুয়াশা আর কনকনে ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে মকর সংক্রান্তিতে ঘাটালের শিলাবতীর নদীর ঘাটে ভোর থেকে উপচে পড়া ভিড়। টুসু ঠাকুর নিয়েও এদিন ভিড় করে কচিকাঁচারা।
এই গঙ্গাসাগরকে শুধু দু’ দিনের জনসমাগম দিয়ে বোঝা যাবে না। মেলা না হয় শেষ হবে।
মকরসংক্রান্তির পর মাঘী পূর্ণিমা, শিবরাত্রি, মহালয়াতেও স্নানে সেখানে জড়ো হন লাখো লাখো মানুষ।