বনগাঁ : বাঙালির সবচেয়ে বড় আবেগের নাম দুর্গাপুজো। আজকের দুর্গাপুজোর ইতিহাস প্রায় ৭০০০ বছরেরও বেশি পুরনো।
আজকের বাঙালির কাছে যা বাসন্তী পুজো, সেটাই কিন্তু একটা সময় ছিল সত্যিকারের দুর্গা আরাধনার সময়। তবে ত্রেতাযুগে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় পেতে অকাল বোধন করেন রামচন্দ্র। আর সেই থেকেই বাঙালির কাছেও এই অকাল বোধন হয়ে উঠেছে আসল দুর্গাপুজো। বছরের এই সময় মেতে ওঠে গোটা দেশই।
তবে এবছর বাংলার চিএটা অন্য রকম । আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে খুন-ধর্ষণের ঘটনার পরে দোষীদের শাস্তির দাবিতে রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।ডেডলাইন শেষে, পুজোর মধ্যেই আমরণ অনশনে বসেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা । নাগরিক সমাজ পথে নেমে সরব হয়েছেন বহুবার। তার আঁচ এসে পড়েছে ইছামতীর শহর বনগাঁতেও।
আরজিকর -এ তরুণী চিকিৎসক খুনের যন্ত্রণা রয়ে গিয়েছে বুকের মাঝে। রয়েছে দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ বন্যায় ভাসার ব্যথাও। সেসব বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখেই ঘরের মেয়ে উমার আরাধনায় মেতে উঠেছে আট থেকে আশি।
আর জি কর-কাণ্ডের পরে পুজো উদ্যোক্তারা দোলাচলে ছিলেন, আয়োজনে কাটছাঁট হবে কিনা, সেই ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তবে পরে পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়। পুজো উপলক্ষে এখানে অসংখ্য পত্রপত্রিকা, লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। এ বার সে সব অবশ্য সংখ্যায় কমে গিয়েছে।
পুলিশ-প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বার বনগাঁ শহরে সব মিলিয়ে পুজো হচ্ছে ১০৩টি। বড় বাজেটের পুজোর সংখ্যা ২১টি। পুজোর দিনগুলিতে দর্শনার্থীদের সাহায্যের জন্য ৭টি পুলিশ সহায়তা কেন্দ্র থাকছে। যানজট নিয়ন্ত্রণে ৩৭টি ড্রপগেট করা হচ্ছে। থাকছে পুজোর গাইড ম্যাপ। পুলিশ আধিকারিকেরা মণ্ডপগুলির নিরাপত্তা এবং অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখছেন।
কোথায় কোন ক্লাবের পুজোর থিম কি দেখুন এক নজরে ~
* বনগাঁ স্পোর্টিং ক্লাবের পুজোর থিম, ‘ইতি তোমার প্রিয়তমা।’ চিঠির অতীত ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দিতে পুজো উদ্যোক্তারা মণ্ডপ ভাবনায় চিঠি এবং ডাক ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। মণ্ডপ ডাকঘরের আদলে তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে আধপোড়া, দলা পাকানো চিঠি দেখা যাবে।
*১১-র পল্লি যুব গোষ্ঠীর পুজোর থিম, দক্ষিণ ভারতের একটি উৎসবের আদলে। প্রফুল্লনগর পুজো কমিটি এ বারের থিম, ‘কৈলাস ধাম।’
* কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ির থিমে সেজে উঠছে ১২-র পল্লি স্পোর্টিং ক্লাবের পুজো মন্ডপ ।
* অভিযান সঙ্ঘের পুজো ৭৯ বর্ষের। এ বার থিমস ‘অমৃতের সন্ধানে।’ পরিবেশ সচেতনতার বার্তা দিতে পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে সেজে উঠছে মন্ডপ।
* গান্ধি পল্লি বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাবের থিম, ‘সমারোহে এস হে পরমতর।’ পুজোয় ব্যবহৃত যাবতীয় সামগ্রী দিয়েই তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ।
* বনগাঁ আমলাপাড়া অ্যাথলেটিক ক্লাবের এ বছর প্ল্যাটিনাম জুবিলি বর্ষ। পুজোর থিম, ‘শহর জুড়ে কলতান আমলাপাড়ায় রাজস্থান।’
* সঙ্ঘের পুজোর থিম ‘দে দে পাল তুলে দে মাঝি’।
* প্রতাপগড় স্পোর্টিং ক্লাবের থিম ‘কোমল গান্ধার।’ হিমাচল প্রদেশের কাংড়া চিত্র শিল্পের অন্যতম প্রধান রাগ কোমল গান্ধারের উপরে ভিত্তি করে সেজে উঠছে মন্ডপ।
* আয়রনগেট স্পোর্টিং ক্লাব এবং শিমূলতলা অধিবাসীবৃন্দের পুজোর মণ্ডপ তৈরি হয়েছে কর্নাটকের বিধানসভার আদলে।
*রেটপাড়া স্পোটিং ক্লাবের থিম, ‘মা আসছেন মায়ের ঘরে।’ টিন দিয়ে তৈরি হয়েছে মন্ডপ।
* শান্তি সঙ্ঘের এ বারের থিম, ‘মায়ের পুজোয় বাবাকে স্মরণ।’ মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহকর্তার সংগ্রাম থিমের বিষয়বস্তু।
*জ্ঞানবিকাশিনী সঙ্ঘের পুজোর থিম, ‘ধামসা মাদল।’ বাঁকুড়ার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়েছে এখানে।
* ৩ নম্বর টালিখোলা এগিয়ে চলো সঙ্ঘের থিম, বৃন্দাবনের ‘প্রেম মন্দির।’
* নোবেল স্পোর্টিং ক্লাবের মণ্ডপ হচ্ছে রাজস্থানের প্যাগোডা মন্দিরের আদলে।
* বনগাঁ রেল বাজার ভারত সঙ্ঘের থিম, ‘প্রজাপতির দেশে।’
* পশ্চিমপাড়া স্পোটিং ক্লাবের পুজোয় গাছহীন পৃথিবীর যন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
* চড়কতলা স্পোর্টিং ক্লাবের থিম, ‘বোধোদয়।’
* ইয়ং বেঙ্গল স্পোটিং ক্লাবের থিম ‘কৃষ্ণলীলা পার্ক।’
* ঠাকুরপল্লি ইউনাইটেড স্পোটিং ক্লাবের থিম, ‘পাখি সব করে রব।’
* বিদ্যায়তন ক্লাবের ক্লাবের থিম, ‘মহাপীঠ তারাপীঠ।’
* গোপালনগরের পাল্লা দক্ষিণপাড়া পুজো কমিটি ৮৯ বর্ষে থিম করেছে ‘দহন।’ ক্রমাগত গাছ কাটা, অতিমাত্রায় প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে যে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশ দূষণ ঘটছে, সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
* গোবরডাঙ্গা গরপাড়া বিধান স্মৃতি সংঘের থিম আদিবাসী গ্রাম
* সুভাষনগর সেবা সমিতির মণ্ডপে দেখা যাবে বারাণসীর গঙ্গা আরতি।
* জয়পুর সবুজ সঙ্ঘের পুজোয় সম্প্রীতির নজির। হিন্দু ও মুসলিম ভাইদের কাঁধে চড়েই এখানে মা আসবেন মণ্ডপে।
এদিকে আকাশে এখনও কালো মেঘের ভ্রূকুটি। বাধ সাধছে পারে বৃষ্টি অসুর। কিন্তু সব বাধাকে হেলায় উড়িয়ে প্রাণের পুজোয় মাতল বাংলা। মহালয়া থেকেই কলকাতায সহ সীমান্ত শহর বনগাঁয় শুরু হয়ে গিয়েছে প্যান্ডেল হপিং। চলছে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটার সঙ্গে দেখে নেওয়া চলছে প্যান্ডেল তৈরির কাজ। অনেকে আবার ঢুঁ মারছেন কুমোরটুলিতে। শিল্পীর তুলির টানে চোখ মেলে তাকাচ্ছেন মৃন্ময়ী প্রতিমা। সেই দৃশ্য মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় বন্দি করার সুযোগ ছাড়তে নারাজ অনেকে। মফঃস্বলে অসমাপ্ত মণ্ডপেই শুরু হয়ে গিয়েছে সেলফি তোলার হিড়িক।
প্রতিবারের মতো এবারও থিম বনাম সাবেকিয়ানার লড়াই যে জমে উঠবে, তার আঁচ মিলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। নজর থাকছে বনেদিবাড়ির পুজোতেও।