ড. কল্যাণ চক্রবর্তী – অরিত্র ঘোষ দস্তিদার

কৈলাস ছেড়ে দেবী দুর্গা মর্ত্যধামে আসছেন। সাময়িক আশ্রয় নেবেন ‘শিবের ফ্ল্যাটবাড়ি’ বিল্ববৃক্ষে। মায়ের প্রতিমার উপরে ভগবান শিবের আশীর্বাদী ছবি আঁকা হবে। সপরিবারে সহধর্মিণীকে পাঠিয়ে তিনি সর্বদাই চিন্তিত। যোগীরাজ নিজে আসবেন না, কিন্তু তিনি ত্রিনয়ন খুলে তাঁর পরিবারের খোঁজ রাখবেন অনুক্ষণ। আবার দশমীর দিন কৈলাশ থেকে তাঁর প্রিয় পাখি নীলকন্ঠ (Indian roller, Coracias benghalensis পরিবার Coraciidae)-কে পাঠিয়ে দেবেন, যাতে দেবী চার পুত্রকন্যাকে নিয়ে ঠিক মতো ফিরে আসতে পারেন কৈলাশে। উড়ে উড়ে পথ দেখাবে নীলকন্ঠ পাখি। এজন্যই দশমীতে নীলকন্ঠ পাখি ছাড়ার নিয়ম।

ষষ্ঠীর বোধনে সন্ধ্যাবেলায় সেই বিল্বতরুকে আমরা তাই আহ্বান করবো — “ওঁ মেরুমন্দর-কৈলাস-হিমবচ্ছিখরে গিরৌ। জাতঃ শ্রীফলবৃক্ষ ত্বমম্বিকায়াঃ সদা প্রিয়ঃ। শ্রীশৈলশিখরে জাতঃ শ্রীফলঃ শ্রীনিকেতনঃ। নেতব্যোহসি ময়গচ্ছ পুজ্যো দুর্গাস্বরূপতঃ।।” শিবের সঙ্গে বিল্ববৃক্ষের সম্পর্ক। এই যোগাযোগ প্রাচীন বৃক্ষপূজার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

আমরা কেন এমন পার্ক-গার্ডেন রচনা করতে পারি না, যাকে বলা যায় ‘শিববাগ’, ‘কৃষ্ণকানন’, ‘শক্তিবাগান’ অথবা ‘বাণী-মালঞ্চ’? মহাদেবের পছন্দের ফুল-লতা রোপণ করে তৈরি হতে পারে ‘শিববাগ’। রাধাকৃষ্ণের অভিসার যাত্রার পথে যেসকল ফুল ফুটেছিল কাননে কাননে, তাই নিয়ে গড়ে উঠতে পারে ‘কৃষ্ণকানন’। জবা-অতসী-দাড়িম্ব-বেল ইত্যাদি গাছ দিয়ে সাজানো হবে দেবী দুর্গার ‘শক্তিবাগ’। সালোকসংশ্লেষের দেবী সরস্বতীর প্রিয় ফুল, পঞ্চপল্লব, পঞ্চশস্য দিয়ে তৈরি হবে ‘বাণীমালঞ্চ’।

শিবের পছন্দের ফুল যেমন আকন্দ, ধুতুরা, বেলপাতা। আকন্দ Calotropis gigantea , Family: Apocynaceae; ধুতুরা Datura stramonium , Family: Solanaceae; বেলপাতা, Aegle marmelos , Family: Rutaceae; ভাঁটফুল / ঘেঁটুফুল Clerodendrum infortunatum , Family : Lamiaceae (under Verbenaceae)। ভাটফুল বসন্তকালে ফোটে। আকন্দ, ধুতুরা সারাবছরই পাওয়া যায়। এইসব ফুল বাংলায় সুলভ, সহজলভ্য; তার বিস্তারণও চোখে পড়ার মতো। আগাছার মতোই বেড়ে ওঠে পতিত জমিতে। বিনা যত্নে, সার-জল ছাড়াই তার অঢেল ফুল। ভগবান শিবও বাঙালি জীবনে এক অমোচ্য সত্য, এক দারুণ দৈনন্দিনতা।

শিব যে কৃষি দেবতা, তার প্রমাণ পাই বাংলার একটি প্রচল কথায়, “ধান ভানতে শিবের গীত।” ফসল পাবার পর ধান ভানার অবসরে শিবকে ধন্যবাদ জানানো হয়। ‘শিবায়ন’ কাব্যে শিব কৃষকরূপে কল্পিত। শিবের মাহাত্ম্য প্রচার বিষয়ক একটি গ্রন্থ। তা কৃষক শিবের লৌকিক গার্হস্থ্য দাম্পত্য জীবন কাহিনী। শিবের কৃষিকাজের বর্ণনা আছে, শিবায়নে।


“মনে জান্যা মঘবান্ মহেশের লীলা।
মহীতলে মাঘ শেষে মেঘরস দিলা।।
দিন সাত বইবাত পাইয়া ঈশানে।
হৈল হল-প্রবাহ শিবের শুভক্ষণে।।”
খনার বচনে পাওয়া যায়, “যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।” মাঘ মাসের শেষে বৃষ্টি হলে, তা মাটিতে যে রসের সঞ্চার করে, তা দিয়েই সেই মরশুমে কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় জলের চাহিদা মেটে, দেশের কল্যাণ হয়।

রাজাও তাই বিনা চাপে রাজস্ব আদায় সক্ষম হন। শিবায়নে দেখা যায়, মাঘ মাসের শেষে ‘মেঘরস’ বা বৃষ্টি হচ্ছে দেবতা মহেশের আশীর্বাদে। তারপর অনুকূল বায়ুপ্রবাহে মাটির উত্তম ‘জো’ (Fine tilth condition) আসে, তখনই হল-প্রবাহ বা লাঙল চালনা সহজ হয়। এই ভৌম আর্দ্রতা গ্রীষ্মকালীন সব্জির চাষ যেমন তরমুজ, ঢেঁড়শ, করলা, শসা, লাউ, চালকুমড়ো, মিষ্টিকুমড়ো প্রভৃতি ফসলের সহায়ক। তা মাঠের ফসল যেমন কলাই, মুগ, চীনাবাদাম, তিল, সূর্যমুখী চাষেরও সহায়তা করতে পারে। রোপণ করা যায় বোরোধান।


শিবায়ন কাব্যে ফসল চাষের পর বীজ তুলের রাখার আবশ্যিক কথাও আছে, “অগ্রভাগ বীজ রাখ বুনিবার তরে।/পুড়্যা ভাঙ্গা পেল্যা রাখ পড়্যা থাকু ঘরে।”

শূণ্যপুরাণে ‘অথচাষ’ অধ্যায়ে শিবের দুঃখে কাতর হয়েছেন তাঁর ভক্ত। ভুলে গেছেন নিজের দুঃখও। শিবকে চাষ করার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি —
“আহ্মর বচনে গোসাঞি তুহ্মি চষ চাষ।
কখন অন্ন হএ গোসাঞি কখন উপবাস।”
শিবকে ভিক্ষে করে খেতে হয়, কোনোদিন কিছু জোটে, কোনোদিন নিরম্বু উপবাস। তার চেয়ে শিব ধান চাষ করুন, ধান ভানুন, তাঁর কষ্ট দূর হবে —
“ঘরে ধান্ন থাকিলেক পরভু সুখে অন্ন খাব।
অন্নর বিহনে পরভু কত দুঃখ পাব।। “

শিব অর্ধ উলঙ্গ, তাকে বাঘছাল পরে কাটাতে হয়; তারচেয়ে শিব কাপাস বুনুন, তুলো থেকে সুতো করে কাপড় বুনুন; তবে শিব সুখী হবেন।
ভক্ত তার আরাধ্যকে বলছেন —
“সকল চাষ চষ পরভু, আর রুইও কলা।
সকল দব্ব পাই যেন ধম্মপূজার বেলা।”
‘শিবায়ন’ কাব্যে শিবের চাষ-সজ্জা, বীজ সংগ্রহ, জমিতে যাত্রা, ফসলোৎপাদনের বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
“দিন সাত বরষিয়া দিলেক ঈশানে।
হৈল হাল-প্রবাহে শিবের শুভক্ষণে।

শিবের যে দারিদ্র্য, তা আসলে বৈরাগ্যের নামান্তর। তাঁর স্ত্রী স্বয়ং অন্নপূর্ণা, অন্নদাতা, অথচ তিনি ভিখারি। এ এক অভূতপূর্ব বৈপরীত্য! একটা প্রবল প্যারাডক্স, ব্যঞ্জনাধর্মী ব্যাখ্যান। ধন নেই, তা বড় ব্যাপার নয়; ধন মহাদেবের প্রয়োজন নেই। দারিদ্র্যের মধ্যে তো তাঁর অতৃপ্তি নেই! তা বোঝানোর জন্যই তো তিনি শ্মশানচারী! যিনি সিদ্ধিতে নিপুণ, তাঁর পার্থিব ধন-সম্পদের প্রয়োজন আছে কি? অন্নের বেদিতে শুয়ে থাকতে পারে বৈরাগ্যই; যিনি ত্রিগুণাতীত। তা বোঝাতেই তিনি শ্মশানবাসী। সেই শিবকে কৃষিকাজ করার পরামর্শ দিচ্ছেন ভক্ত, তাঁর দুঃখে চোখের জল। এটাই যথার্থ ঈশ্বর প্রেম।

একমাত্র সনাতনী সংস্কৃতিতেই এই বোধের হদিশ মেলে। আর কোথাও সম্ভবত পাওয়া যাবে না। মানুষের বোধের অন্তঃস্থলে শিব কৃষিদেবতা হয়ে যান অনবধানে। ধান ভানতে সেই দেবতাই মনের মধ্যে আবির্ভূত হন। বোরো চাষের অবসরে চড়কের পূজায়, খরিফ মরশুমে শ্রাবণের বরষার শিবরূপী ফসলের ঢেউ খেলে যায়। সবমিলিয়েই বাংলার শিব; এক কৃষি বাস্তুতন্ত্রের প্রতীক। তিনিই সব হয়েছেন, তিনিই চৈতন্য-স্বরূপ, তিনিই স্বয়ম্ভু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here