দেশের সময়: মহাপ্রভু নির্দেশ দিয়েছেন, গৃহী হতে হবে নিতাইকে। সেই নির্দেশ পালনে সূর্যদাস পণ্ডিতের বাড়িতে এলেন নিত্যানন্দ।
বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন নিতাই। ভিতরে ঢুকলেন সঙ্গে থাকা উদ্ধারণ দত্ত। সূর্যদাসকে ডেকে তিনি বললেন, তোমার মেয়ের জন্য পাত্র এনেছি।

কে সে?
উদ্ধারণ বললেন, সে উত্তম ব্রাহ্মণ। সর্বশাস্ত্রে শ্রেষ্ঠ। রাঢ়চূড়ামণি। তাঁর বাস প্রেমানন্দে। নাম নিত্যানন্দ।
শুনলেন বটে। কিন্তু খুব একটা উৎসাহিত হলেন না সূর্যদাস। ফলে ফিরে গেলেন নিত্যানন্দ।
এদিকে নিতাইচাঁদ তাঁর পাণিপ্রার্থী জেনে অন্তরে প্রেম জাগল বসুধার। কিন্তু বাবা তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, শোনামাত্রই মূর্চ্ছা গেলেন তিনি। ডাক্তার-বদ্যি ডাকা হল। তবুও মূর্চ্ছা ভঙ্গ হয় না তাঁর।

ভাই গৌরীদাস খবর পেয়ে ছুটে এলেন। তিনি দাদা সূর্যদাসের পায়ে পড়লেন। বললেন, তুমি নিত্যানন্দকে ফিরিয়ে আনো। সেই বসুধার প্রাণ ফেরাতে পারবে।
গৌরীদাসের কথা শুনে নিতাইয়ের খোঁজে বের হলেন সূর্যদাস। গঙ্গার ধারে দেখা পেলেন তাঁর। জোড়হাতে প্রার্থনা করলেন, তুমি আমার মেয়ের জ্ঞান ফিরিয়ে দাও।
মৃতপ্রায় বসুধাকে সঞ্জীবনী সুধায় বাঁচিয়ে তুললেন নিতাই। এবার আর মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারলেন না সূর্যদাস।
বললেন, তুমি যা চাইবে, তাই দেব।
নিতাই বললেন, তা হলে আপনার বসুধাকে সমর্পন করুন আমার হাতে।
রাজি হয়ে গেলেন সূর্যদাস।

অম্বিকার বাড়িতে নিতাইচাঁদের বিয়ের দিন স্থির হল। সূর্যদাসের বাকি ভাই ও আত্মীয়স্বজনরা তখন প্রায় সবাই শালিগ্রামে। ফলে সিদ্ধান্ত হল, সেখানেই পিতৃভিটেয় বিয়ের অনুষ্ঠান হবে।
নবদ্বীপ থেকে খানিকটা দূরে বড়গাছির কাছে শালিগ্রাম। প্রশস্ত বিষ্ণু মণ্ডপে বসে আছেন নিতাই। মহাপ্রভুর আজ্ঞা পূরণের দিন আজ। সালটা ১৫১৯। সূর্যদাসের বড় মেয়ে বসুধার সঙ্গে বিয়ে হল নিত্যানন্দর।

বসুধার সঙ্গে তো বিয়ে হল নিত্যানন্দের। তা হলে জাহ্নবী! তাঁকে কেন প্রথম স্ত্রীর বোনকে বিয়ে করলেন নিতাই?
নিত্যানন্দের চতুর্দশ বংশোধর শ্রীসরোজেন্দ্রমোহন গোস্বামী বলছেন, তখন বসুধার সঙ্গে নিতাইচাঁদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। একদিন নিত্যানন্দানুরাগী জাহ্নবা দিব্য বসন পরে অবগুণ্ঠনবতী হয়ে ব্যাঞ্জনের থালা হাতে হৃদয় দেবতাকে পরিবেশন করছেন। এমন সময় আচমকা প্রাণবল্লভের মুখ দেখে আনন্দে তাঁর অবগুণ্ঠন বস্ত্র পড়ে যায়। জাহ্নবার দুই হাত আবদ্ধ। কী করে তিনি বস্ত্র সংযত করবেন। এই সঙ্কটে নিত্যানন্দশক্তি জাহ্নবা ঐশ্বর্য লীলা প্রকট করেন। তিনি আরও দু’টি হাত প্রকাশ করেন। এবং সেই হাত দিয়ে সংযত করেন নিজের অবগুণ্ঠন।

ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা পূরণ করলেন ইচ্ছাময়ী। জাহ্নবার ওই অপূর্ব ঐশ্বর্য দেখে তাঁর প্রাণবল্লভকে চিনে নিলেন নিত্যানন্দ। দুজনের চোখেই পরিস্ফুট হল মনের ভাব। মুখের স্মিত হাসি। সেই হাসি যেন বলে দিচ্ছে, একে অপরকে চিনতে পেরেছেন তাঁরা। কিন্তু কোনও কথা হল না।
পরদিন নিতাইচাঁদ ভাবলেন, মনের কথা আর গোপন রাখা উচিত নয়। শ্বশুরের কাছে গিয়ে তিনি বলে ফেললেন। যৌতুক চাইলেন জাহ্নবাদেবীকে।
জাহ্নবাদেবীর জন্ম ১৪৩১ শকাব্দ অর্থাৎ ১৫০৯ খ্রিষ্টাব্দ। অম্বিকা-কালনায়।


নিত্যানন্দের শ্বশুরকুলের পরিচয় কী?
সূর্যদাস ছিলেন বাংলার তৎকালীন সুলতানের দরবারে উচ্চপদস্থ কর্মচারী। কর্মদক্ষতার নিরিখে সরখেল উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। কোন সুলতান তাঁকে এই উপাধি দিয়েছিলেন তা নিয়ে অবশ্য স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় না।
সূর্যদাস ও গৌরীদাস দুজনেই শাস্ত্রজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। গৌরীদাস রচিত পদ সেকালে সমাদৃত ছিল বৈষ্ণব সমাজেও।

ঈশাননাগর রচিত শ্রীশ্রী অদ্বৈতপ্রকাশ ও নিত্যানন্দ দাস রচিত প্রেমবিলাস গ্রন্থে নিত্যানন্দ প্রভু কর্তৃক জাহ্নবাদেবীকে যৌতুক নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নিত্যানন্দ বংশোধর সরোজেন্দ্রমোহন গোস্বামী বলছেন, নিতাইচাঁদ যে জাহ্নবাদেবীকে যৌতুক নিয়েছিলেন এবং সূর্যদাস পণ্ডিত যে তাঁর ছোট মেয়েকে নিতাইচাঁদকে দান করেছিলেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন, নিত্যানন্দ জাহ্নবাদেবীকে বিয়ে না করেই গ্রহণ করেছিলেন কিংবা গান্ধর্ব মতে বিয়ে করেছিলেন, তা নিতান্তই অসঙ্গত এবং অসমীচিন হবে। জাহ্নবা নিত্যানন্দ প্রভুর বিবাহিতা পত্নী। ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থেও তার উল্লেখ রয়েছে। জাহ্নবাদেবীকে নিত্যানন্দ বিয়ে করেন, সালটা ১৫২১।

সূর্যদাসের অনুমতিক্রমে নানা অলঙ্কারে সাজিয়ে নিতাইচাঁদের দুপাশে দাঁড় করানো হয় বসুধা ও জাহ্নবাদেবীকে। নারীরা শুভ মাঙ্গলিক উলুধ্বনি দিতে থাকেন। গৌরদাস পণ্ডিত কীর্তন করতে থাকেন।
গৌরগণোদ্দেশদীপিকা গ্রন্থ বলছে, ভাগবতে বলরামের দুই স্ত্রী। রেবতী ও বারুণী। মহাপ্রভুর নদীয়া লীলায় তাঁরাই নিত্যানন্দের স্ত্রী হয়েছিলেন। রেবতী হন বসুধা। আর বারুণী হন জাহ্নবা। কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে, জাহ্নবা ও বধুসা আসলে ব্রজলীলার অনঙ্গমঞ্জরীর অবতার। যিনি ছিলেন শ্রীরাধার কনিষ্ঠ ভগিনী ও বলরামের লীলাসঙ্গীনি। জাহ্নবাকে নিয়ে লেখা হয়েছে প্রচুর স্তুতিকাব্য। রয়েছে তাঁর জীবনগাথাকেন্দ্রিক কাব্য অনঙ্গমঞ্জরী সম্পূটিকা, জাহ্নবাতত্ত্ব মর্মার্থ, অনঙ্গকদম্বাবলী, জাহ্নবাষ্টকম। এর মধ্যে অনঙ্গকদম্বাবলী লেখেন সুভদ্রা দেবী। যেখানে একজন নারী হয়ে তুলে ধরেছেন আর এক নারীর অবদানের কথা। বৈষ্ণব পদাবলি ও কীর্তনেও উঠে এসেছে জাহ্নবা-বন্দনা। নিত্যানন্দ বন্দনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জুড়ে গিয়েছে ঈশ্বরী জাহ্নবার স্তুতি।

ভক্তিরত্নাকর অনুযায়ী বিয়ের পর দুই স্ত্রীকে নিয়ে নিত্যানন্দ বড়গাছির রাজা হরিহরের পুত্র কৃষ্ণদাসের বাড়িতে ওঠেন। সেখানে থাকেন কিছুদিন।
শ্রীবসু-জাহ্নবা সহ প্রভু নিত্যানন্দ।
আইলেন বড়োগাছিতে হৈল মহানন্দ।।
শ্রীবাসের ভার্যা-আদি প্রবীণা সকল।
কৈল যে বিহিত হৈয়া আনন্দে বিহ্বল।।
বড়গাছির পর নিত্যানন্দ স্ত্রীদের নিয়ে যান নবদ্বীপে শচীমাতার আশীর্বাদ নিতে।
যাই একবার মাকে দেখে আসি।
নিতাইকে পেয়ে খুশি আর ধরে না শচীমায়ের।

বাপ, তুমি অন্তর্যামী। আমার দুঃখী মনের অভিলাস বুঝতে পেরে আমাকে দেখা দিতে এসেছ।
মা, তোমার চরণ দর্শন করতে এসেছি। সাথে তোমার দুই বউমাকেও নিয়ে এসেছি।
বসুধা ও জাহ্নবাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন শচীমা। আজ আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে তা বলে বোঝাতে পারব না।
শ্রীবসু জাহ্নবা দোঁহে দেখি এথা আই।
করিল যতেক স্নেহ কহি সাধ্য নাই।।
নিতাই, বাপ আমার। কিছুদিন থাকো নবদ্বীপে। আমাকে একা রেখে আর চলে যেও না।
তাই থাকব মা। প্রতি ঘরে সংকীর্তন বসাব।
কথা দিলেন বটে। কিন্তু খুব বেশিদিন থাকা হল না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here