দেশের সময়: একদিকে কয়লার কয়েকগুণ দাম বৃদ্ধি। তার সঙ্গে রয়েছে জিএসটির খাঁড়া। গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো চেপে বসেছে দূষণ পরিমাপের পদ্ধতি বদল। সঙ্গে শ্রমিকদের মজুরির উপর নতুন করে জিএসটি। সবমিলিয়ে দিশাহারা ইটভাটা মালিকরা। ফলে এবার একযোগে সমস্ত ইটভাটা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। মালিকদের এই সিদ্ধান্তের জেরে কালীপুজোর পর থেকে রাজ্যের প্রায় ৭ হাজার ইটভাটার গেটে তালা পড়তে চলেছে। এর ফলে প্রায় ১৫ লক্ষ শ্রমিক সরাসরি বেকার হয়ে পড়বেন। ভাটায় ইট তৈরি বন্ধ হয়ে গেলে ব্যাপক প্রভাব পড়বে নির্মাণ শিল্পে। সেখানেও লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেরোজগার হয়ে পড়বেন। রুটি-রুজি বন্ধ হতে বসায় রাজ্য তথা দেশজুড়ে ইটভাটা শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছেন।

দিনদিন তাঁদের আন্দোলনের ঝাঁঝ বাড়ছে। ভাটা শ্রমিকদের বক্তব্য, দীর্ঘদিন ধরে ইটভাটায় কাজ করেই তাঁদের সংসার চলে। এখন ভাটা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা খাবেন কী। কীভাবে তাঁদের সংসার চলবে? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য ইটভাটা মালিকদেরও জানা নেই। তাঁদের বক্তব্য, আমরা তো ভাটা চালাতে চাই। কিন্তু এর জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। যেভাবে ভাটা মালিকদের উপর আর্থিক ব্যয়ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তা লাঘব করতে হবে। তবেই ভাটা চালু রাখা সম্ভব। নতুবা নয়। নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে ভাটা মালিকরা ঘন ঘন বৈঠক করছেন।

এখনও পর্যন্ত যা সিদ্ধান্ত, তাতে আগামী নভেম্বর মাস থেকে ইটভাটাগুলিতে নতুন মরশুম শুরুর কথা। সেইমতো অক্টোবরের চতুর্থ সপ্তাহেই ভিন রাজ্যের শ্রমিকরা চলে আসেন। পাশাপাশি স্থানীয় শ্রমিকরাও কাজে যোগ দেন। কিন্তু এবার ঠিকাদারদের বলে দেওয়া হয়েছে, কোনও শ্রমিক লাগবে না ভাটায়। কারণ, তাঁরা ভাটা চালাতে পারবেন না। মালিকদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানার পরই মুষড়ে পড়েছেন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ও তাঁদের পরিবার।

কোথায় সঙ্কট?

ইটাভাটা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, সমস্যা মূলত তিন জায়গায়। একদিকে কয়লার প্রচুর দাম বৃদ্ধি। সঙ্গে চেপে বসেছে বিপুল পরিমাণ জিএসটি। লেবার চার্জ অর্থাৎ শ্রমিকদের মজুরির উপর জিএসটির খাঁড়া। দূষণ পরিমাপের পদ্ধতির বদল। এবং ফ্লাই অ্যাশ ব্রিক বা কয়লার ছাই থেকে তৈরি ইট বাজারে প্রতিযোগিতায় নামা। সঙ্গে বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই চলা কিছু ইটভাটা। হিসাব করে দেখা গিয়েছে, বর্তমানে যা পরিস্থিতি, তাতে একটি ইট তৈরি করতে গিয়ে মালিকদের খরচ পড়ছে মোটামুটি ১৬ টাকার মতো। অথচ, বাজারে ১২ টাকার বেশি সেই বিক্রি করা যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন করা মানেই লোকসানের বহর বৃদ্ধি।

অল ইন্ডিয়া ব্রিকস অ্যান্ড টাইলস ফেডারেশনের আওতাধীন ওয়েস্টবেঙ্গল ব্রিক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য বিমল পাল বলেছেন, আমাদের সঙ্কট মূলত তিনটি জায়গায়। প্রথমত, কয়লার দাম বৃদ্ধি। শুধু যে দাম বৃদ্ধি তা নয়, কয়লা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি, সেটারও বিরোধিতা করছি আমরা। দ্বিতীয়ত, জিএসটি বৃদ্ধি কয়েকগুণ। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত যে জিএসটি এক শতাংশ ছিল, এপ্রিল থেকে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬ শতাংশ, আর যে জিএসটি ছিল ৫ শতাংশ, তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২ শতাশ। এর পর রয়েছে দূষণের মাত্রা নির্ধারণের পদ্ধতি। আগে ইটভাটার চিমনিতে ধোঁয়া পরীক্ষা করে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আধিকারিকরা জানিয়ে দিতেন, সেই ভাটা থেকে আদৌও কোনও দূষণ ছড়াচ্ছে কি না। কিন্তু এখন যে এলাকায় ভাটা, সেখানকার বাতাসে কতটা দূষণ রয়েছে, তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট এলাকায় যদি আরও পাঁচটা কলকারখানা থাকে, এবং তারা ইটভাটা থেকে বেশি দূষণ ছড়ায় পরিবেশে, তাও ইটভাটার উপর দায় চাপছে। ভাটা বন্ধ করে দিতে বলা হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। এখন কোনও ভাটায় শ্রমিকদের যে মজুরি দেওয়া হবে, তার উপর ১২ শতাংশ জিএসটি। এক-একটি ভাটায় কয়েকশো শ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের সারা বছরের মজুরির উপর যদি এভাবে জিএসটি বহন করতে হয়, তা হলে টাকার পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে যায়।

ওয়েস্টবেঙ্গল ব্রিক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের অনুমোদিত বনগাঁ সাব ডিভিশন ব্রিক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে বিনয় সিংহ বলেছেন, পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে সরকার যদি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না করে, তা হলে কোনওভাবেই আর ভাটা চালানো যাবে না। আমরা বুঝতে পারছি, ভাটা বন্ধ করলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেরোজগার হয়ে পড়বেন। কিন্তু আমাদেরও দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। আমরা সবসময় চাই, ভাটা চালু রাখতে। কিন্তু পারছি কই। একটা সোজা হিসাব আছে, এক টন কয়লা যে দামে কেনা হবে, সেই টাকায় এক হাজার ইট বিক্রি করতে হবে। কিন্তু তার চেয়ে যদি কম দামে ইট বিক্রি করতে হয়, তা হলেই লোকসান। এখন যা অবস্থা তাতে অনেক কম দামে ইট বিক্রি করতে হচ্ছে। কিছু ইটভাটা চলছে কাগজপত্র ছাড়াই। তাদের ঝক্কি ঝামেলা কম। ফলে তারা কিছুটা কম দামে ইট বিক্রি করতে পারছে। কিন্তু যাঁরা বৈধ কাগজপত্র নিয়ে ভাটা চালাচ্ছেন, তাঁদের আরও সমস্যায় জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বেশি দামে কয়লা কিনতে তো হচ্ছেই, তাও জোগান পর্যাপ্ত নেই। সময়ে কয়লা পাওয়া যাচ্ছে না। জিএসটির খাঁড়া তো চেপেইছে। ভাটার জন্য মাটি পেতেও সমস্যা। বলা হচ্ছে, ই-চালানে মাটি কিনতে হবে। গোটা প্রক্রিয়াটাই পোর্টালের মাধ্যমে করতে হবে। এর জন্য প্রতিটি ভাটায় কম্পিউটার, ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। কম্পিউটার জানা লোক রাখতে হচ্ছে। এসব করতে গেলে খরচ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে।

সূত্রের খবর, উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় ৮৬২টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে বসিরহাট মহকুমায় ভাটার সংখ্যা ৫৮০টি। বনগাঁ মহকুমায় ৩৫টির মতোর ভাটা রয়েছে। এই জেলায় যদি ইটভাটাগুলি বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে আড়াই লক্ষের বেশি শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বে। পুজোর মুখে এই খবরে তাঁদের মুখের হাসি উধাও হয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি বসিরহাটের রবীন্দ্রভবনের এক সভায় উত্তর ২৪ পরগনা ইটভাটা মালিক সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী দু’বছর তারা ভাটা বন্ধ রাখবে। মালিক সমিতির সম্পাদক মান্তু ঘোষ বলেছেন, কয়লা সহ অন্যান্য সরঞ্জামের দাম যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে ইটের দাম বাড়ছে না। তাই লক্ষ লক্ষ টাকা ক্ষতি হবে জেনেও ভাটা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ ব্রিক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং অল ইন্ডিয়া ব্রিক অ্যান্ড টাইলস ম্যানুফাকচারার্স ফেডারেশনের সহ সভাপতি যোগেশ আগরওয়াল বলেছেন, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরেই সবথেকে বেশি কয়লা ব্যবহার করা হয় ইটভাটায়। অথচ সরকার সহযোগিতা না করায় কয়েকগুণ বেশি টাকা দিয়ে আমাদের কয়লা কিনতে হচ্ছে। জিএসটির ফলে ১৫ লক্ষ টাকা খরচ বেড়েছে। সরকার যদি এভাবে একটি ছোট শিল্পের উপর আঘাত হানে, ব্যবসা করে যদি দু’পয়সার মুখ দেখা না যায়, তা হলে ব্যবসা করে আর লাভ কী। এভাবে চলতে থাকলে ভাটা মালিকদের পুঁজি সব শেষ হয়ে যাবে। এবং ইতিমধ্যেই অনেকের পুঁজি শেষের পথে। এর পর তাঁরা আর কোনওভাবেই ভাটা চালাতে পারবেন না।

কিছুদিন আগেই উত্তরবঙ্গের ইটভাটা মালিকদের নিয়ে রায়গঞ্জের মিউসিপাল পার্কে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে অংশ নিয়েছিলেন দার্জিলিং, মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ভাটা মালিকরা। সভায় যোগ দেন মালিক সংগঠনের রাজ্য সভাপতি যোগেশবাবু। সেখানে তিনি বলেন, কেন্দ্রের নির্দেশিকায় তাঁরা মহা ফাপড়ে পড়েছেন। ইট উৎপাদনের খরচ যেভাবে বেড়েছে, তাতে আমরা ন্যায্য দামে ইট বিক্রি করতে পারছি না। ফলে বাধ্য হয়ে ইট উৎপাদন কমিয়ে দিতে হয়েছে। তাতেও দৈনন্দিন খরচ তোলা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর দাবি, জিএসটি বেড়েছে ২৪০ থেকে ৬০০ শতাংশ। কয়লার দাম বেড়েছে ৩৫০ শতাংশ। এর পাশাপাশি রাজ্য সরকারের বিভিন্ন আইন ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা নিরুপায়। কারণ, সাধারণ মানুষের কথা ভেবে আমরা ইটের দাম বৃদ্ধি করতে পারছি না। ফলে কালীপুজোর পর থেকে আমরা ভাটা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

ভাটা যে বন্ধ হচ্ছেই, সেই সম্ভাবনাকে কার্যত সিলমোহর দিয়ে দিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক দিলীপকুমার ঘোষ। তিনি বলেন, পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে ভাটাগুলি যদি এখন বন্ধের নোটিশ ঝুলিয়ে দেয় গেটে, আমাদের কিছু করার বা বলার থাকবে না। কারণ, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে তাঁদের। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের নামে ইটশিল্পের উপর কার্যত জুলুম চলছে। অতিরিক্ত ভর্তুকি দিয়ে ফ্লাই অ্যাশ ইট এবং এএসি ব্লককে উৎসাহিত করা হচ্ছে সরকারের তরফে। আমাদের দাবি, জিএসটিতে ছাড় দিতে হবে। কয়লা পাওয়ার ক্ষেত্রেও বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

কয়লা নিয়ে সমস্যা কোথায়? বিমল পাল বললেন, কেন্দ্রীয় সরকার ফ্লোর রেটে বিভিন্ন উৎপাদক সংস্থাগুলিকে কয়লা দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে টন প্রতি তার দাম ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা। ইটভাটাও ম্যানুফাকচারার সংস্থা। আমরাও উৎপাদন করি। কিন্তু আমাদের ফ্লোর রেটে কয়লা দেওয়া হয় না। আমাদের কয়লা কিনতে হয় ট্রেডার্সদের কাছ থেকে। সরকার ফ্লোর রেটে বিভিন্ন সংস্থাকে কয়লা দেওয়ার পর বাকি কয়লা ই-টেন্ডার করে। সেই টেন্ডারে বেশি দাম দিয়ে কয়লা কেনেন ট্রেডার্সরা। তার পর ট্রেডার্সরা নিজেদের মুনাফা রেখে আমাদের কাছে কয়লা বিক্রি করেন। ফলে আমাদের টন প্রতি কয়লা কিনতে হয় ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায়। এনিয়ে আমরা বহুবার সরকারের কাছে দরবার করেছি। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। বিনয় সিংহ বলেছেন, দিন দিন কয়লার এই রেট বাড়ছে। তাও তা পর্যাপ্ত নয়। কয়লা ছাড়া ভাটা চলবে কী করে।

জিএসটির খাঁড়া কতটা? বিমলবাবু বললেন, ইটভাটায় দু’ধরনের জিএসটি কার্যকর। এক ধরনের হল, ইটভাটায় যেসমস্ত সরঞ্জাম দরকার হয়, তার উপর ৫ শতাংশ জিএসটি। এক্ষেত্রে কিছুটা ফেরত পাওয়া যায়। আর দ্বিতীয় ধরনটি হল, কিছু ফেরত পাওয়া যাবে না, এই শর্তে এক শতাশ হারে জিএসটি দিতে হবে। ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই হারেই জিএসটি কার্যকর ছিল। কিন্তু এপ্রিল থেকে নিয়মে বদল আনা হয়েছে। এখন ফেরত পাওয়া যাবে, এই যে ক্যাটাগরি অর্থাৎ যেখানে ৫ শতাংশ জিএসটি চাপানো ছিল, তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২ শতাংশ। আর যে ক্যাটাগরিতে ১ শতাংশ জিএসটি ছিল, তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬ শতাংশ। এতে আমাদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে পুঁজি।

দূষণ নিয়ে আপত্তি কোথায়? বিমলবাবু বলছেন, আমাদের বলা হয়েছিল, জিগজ্যাক সিস্টেমে ভাটা করো। দূষণের বিষয়টি নিয়ে সমস্যা হবে না। আগে ভাটায় এসে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কর্মীরা চিমনির ধোঁয়া পরীক্ষা করে দেখতেন, সেই ভাটা থেকে কতটা দূষণ ছড়াচ্ছে। কিন্তু এখন তা করা হচ্ছে না। একটি এলাকার বাতাস কতটা দূষিত তা মাপা হচ্ছে। এবং দূষণের মাত্রা বেশি হলে তার দায়ভার এসে পড়ছে সেই এলাকায় থাকা ইটভাটার উপর। অথচ দেখা যাচ্ছে, ইটভাটা ছাড়াও সেই এলাকায় আরও দশ ধরনের কলকারখানা রয়েছে। আমাদের প্রশ্ন, ওইসব কলকারখানা থেকেও তো দূষণ ছড়াতে পারে। তা হলে দায়ভার ইটভাটার উপর এসে পড়বে কেন? বিষয়টি নিয়ে বিনয় সিংহ বলছেন, এ যেন এমন একটা চলছে যে, আমরা দোষ না করলেও অপরাধী হয়ে যাচ্ছি। এভাবে কি চলতে পারে?

লেবার চার্জের উপর জিএসটি কেমন? বিনয় সিংহ বলছেন, শ্রমিকদের মজুরির উপর ১২ শতাংশ জিএসটি চাপানো হয়েছে। এবং তা ভাটা মালিককেই বহন করতে হচ্ছে। ধরুন, কোনও শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা। তা হলে তাঁর মজুরির উপর ৬০ টাকা জিএসটি দিতে হবে। সারা বছর হিসাব করলে এই টাকার পরিমাণ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলতে পারেন! কীভাবে ভাটা চালাব। বিমল পাল বলছেন, একটি ভাটায় একশো শ্রমিক তো দরকার হয়ই। বড় ভাটায় শ্রমিকের সংখ্যা আরও বেশি। তা হলে লেবার চার্জ হিসেবে কত টাকা জিএসটি দিতে হবে মালিককে, সহজেই অনুমেয়।

ফ্লাইঅ্যাশ ব্রিক বা ছাই ইট নিয় সমস্যা !বিমলবাবু ও বিনয়বাবুর বক্তব্য, সরকার ছাই ইটকে বেশি করে ব্যবহার করানোর চেষ্টা করছে। সেকারণেই হয়তো আমাদের উপর এভাবে একের পর এক বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি, সেই বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। তবে মাটি পুড়িয়ে যে লাল ইট তৈরি হয়, তার সঙ্গে কোনওভাবেই ফ্লাইঅ্যাশ ইট টেক্কা দিতে পারবে না। লাল ইটের আয়ু এক হাজার বছর। ফ্লাইঅ্যাশ ইট কতদিন টিকবে? অথচ বিভিন্ন শহরে বহুতল নির্মাণে আর রাস্তা, ফ্লাইওভার নির্মাণে এসব ইট ব্যবহার করা হচ্ছে। ফ্লাইঅ্যাশ ইটকে বেশি ব্যবহারের চেষ্টার কারণ, এর পিছনে বড় বড় শিল্পপতিরা রয়েছেন। তবে ফ্লাইঅ্যাশ ইটের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন বিমলবাবু। তাঁর কথায়, ইউরোপ থেকে একবার শিল্পপতিরা এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে, ইউরোপের দেশগুলিতে ফ্লাইঅ্যাশ ইট বর্জন করা হচ্ছে। কারণ, সেখানে একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ফ্লাইঅ্যাশ ইটের তৈরি ঘরে বাস করলে নানা ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষজন। আমাদেরও বোধ হয় বিষয়টি নিয়ে সজাগ হওয়ার সময় এসেছে।

ইটশিল্পে অচলাবস্থা নিয়ে অবিলম্বে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটু। তাদের বক্তব্য, ইটশিল্পকে বাঁচানোর জন্য কেন্দ্র বা রাজ্য কেউই কোনও উদ্যোগ নেয়নি। কয়লার দামে যেমন কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের, তেমনই মাটির ক্ষেত্রে যেভাবে বেআইনি কার্যকলাপ চলছে, তাতেও সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। দুই সরকারের এই অসহযোগিতার কারণেই ইটভাটা মালিকরা ভাটা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। এর ফলে কাজ হারাতে চলেছেন ১২ লক্ষ থেকে ১৪ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ। সেইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ ক্রেতারাও। এই সঙ্কটের কথা তুলে ধরে সিটুর পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি সুভাষ মুখার্জী ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু বলেছেন, ইটভাটা শিল্পে অচলাবস্থা দূর করতে অবিলম্বে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে।

সিটুর বক্তব্য, ইটভাটা মালিকরা দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের কাছে আবেদন করে চলেছেন, তাঁরা যাতে নিয়ন্ত্রিত দামে সরকারের কাছ থেকে কয়লা পান। কিন্তু তা হয়নি। উপরন্তু প্রশাসনের একাংশ ও দালালচক্রের আঁতাতে মাটি পাওয়াও ইটভাটা মালিকদের কাছে এখন দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তার উপর আবার ইট বিক্রি ও শ্রমিকদের মজুরি চুক্তির উপর চাপানো জিএসটি গোটা শিল্পকেই গভীর সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিবৃতিতে অনাদি সাহু বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে সিটু অনুমোদিত ওয়েস্ট বেঙ্গল টালি ইটভাটা শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন এবং বেঙ্গল ব্রিক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে আবেদন জানিয়েছে। সিটুর বক্তব্য, শুধু কেন্দ্র বা রাজ্য নয়, দুই সরকারকেই শ্রমিকদের স্বার্থে আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করতে হবে। শ্রম দফতর ও ক্ষুদ্র কুটির শিল্প দফতরকে এ ব্যাপারে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারাবেন। এক গভীর সঙ্কট তৈরি হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here