দেশের সময়: নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে করোনা আতঙ্ক। তারই মধ্যে বড়দিনের উৎসবে মেতে উঠেছে গোটা বাংলা। কলকাতার পার্ক স্ট্রিট থেকে শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোড, ব্যান্ডেল থেকে বনগাঁ সর্বত্রই আলোর মালায় সেজে উঠেছে রাজপথ। বড়দিনকে সামনে রেখে বাংলার পর্যটনেও জোয়ার। দার্জিলিং, ডুয়ার্সে ব্যাপক ভিড়। হোটেলগুলিতে ঠাঁই নেই অবস্থা। পর্যটকদের জন্য পাহাড়ে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ২৮ ডিসেম্বর থেকে পাহাড়ে উৎসবের আয়োজন করেছে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ঘোষণা করেছেন, উৎসবের মুহূর্তকে স্মরণীয় করে তুলতে রাজ্য সরকারের তরফে পাহাড়কে সাজিয়ে তোলা হবে।

বড়দিন উপলক্ষে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে দার্জিলিংয়ে হেরিটেজ টয় ট্রেনের সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। ৫ জানুয়ারি থেকে দার্জিলিং-ঘুম রুটে জয় রাইডে নতুন চারটি পরিষেবা যুক্ত হতে চলেছে। প্রতি বছরের মতো এবারও দার্জিলিংয়ের বিভিন্ন গির্জা আলোর মালায় সাজিয়ে তোলা হয়েছে। সেজে উঠেছে হোটেলগুলিও। জিটিএ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সাজিয়ে তোলা হচ্ছে দার্জিলিং চৌরাস্তা ম্যাল। জিটিএর পর্যটন দপ্তরের তরফে চৌরাস্তায় আমরা ২৮-৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দার্জিলিং পর্যটন উৎসবের আয়োজন করতে চলেছি। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে দার্জিলিংকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে এই উদ্যোগ। পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ২৪ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দার্জিলিংয়ে কার্যত কোনও হোটেলেই জায়গা নেই।  জমাটি শীত নেই তো কী! বড়দিনের উৎসবে ভাটা পড়তে দিতে চান না বাংলার মানুষ। 

কলকাতায় অ্যালেন পার্ক ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে দু’দিন আগেই বড়দিনের উৎসবের সূচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্রিসমাস ট্রি, সান্তা ক্লজ আর কেক, সঙ্গে আলোর সাজ, উদ্ভাসিত উৎসব মুখর বাংলা। অন্যান্য বছরের মতো এবার আলোর রোশনাইয়ে সেজে উঠেছে কলকাতার পার্ক স্ট্রিট। সন্ধ্যা নামতেই মায়াবী আলোয় ভেসে যাচ্ছে কলকাতার রাজপথ। মহানগরে ক্রিসমাস উৎসবের সূচনা করে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, একতাই আমাদের শক্তি। দেশে ও গোটা বিশ্বে আমাদের শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বড়দিনের উৎসবের সূচনা করে মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে কেক খাওয়ান। এবার বড়দিন পড়েছে রবিবার। তাই রাজ্য সরকারের তরফে বড়দিনের পরদিন অর্থাৎ সোমবার সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। পার্ক স্ট্রিটের অ্যালেন পার্কে ক্রিসমাস কার্নিভালের সূচনা অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল, মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। এবছর থেকে পার্ক স্ট্রিটের ক্রিসমাস কার্নিভালে যুক্ত হতে চলেছে বো বারাকও। গত বছরই এই ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। গত বছর ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যায় তিনি আচমকা পৌঁছে গিয়েছিলেন বো বারাকে। মূলত বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাতেই সেখানে হাজির হয়েছিলেন তিনি। আলোর মালায় সেজে ওঠা বো বারাকের সামনে দাঁড়িয়ে স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আলাপচারিতা, শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি খোদ মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের পাড়ায় আসায় আপ্লুত হন বো বারাকের বাসিন্দারা।

মুখ্যমন্ত্রীকে ফুলের তোড়া দিয়ে সংবর্ধনা জানান তাঁরা। মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁরা বলেন, উৎসবের দিনে তিনি তাঁদের পাড়ায় এসেছেন, এটাই তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড় উপহার। এখানকার মানুষের পাশে থাকারও বার্তা দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেসময়ই তিনি ঘোষণা করেন, চলতি বছর থেকেই পার্ক স্ট্রিটের  অ্যালেন পার্কে তাঁর দিয়ে সূচনা হওয়া ক্রিসমাস উৎসবে যুক্ত করা হবে বো বারাককেও। এ ব্যাপারে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। তারই ফলস্বরূপ এবার বড়দিনের উৎসবের আবহ বো বারাকেও। আলোর মালায় সেজে উঠেছে গোটা মহল্লা।

রাস্তায় বসানো হয়েছে বিশাল ক্রিসমাস ট্রি। তাতে হরেক রকমের কারুকার্য। অ্যাংলো পাড়া যেন উজাড় করে দিয়েছে সব খুশি। কলকাতার সাহেব পাড়ার পর সবচেয়ে বড় করে বড়দিন পালিত হয় এই অ্যাংলো পাড়ায়। তবে করোনা আবহে গত দু’বছর উৎসবের আনন্দে খানিকটা ভাটা পড়েছিল। এবারও নতুন করে করোনার আতঙ্ক মাথায় চেপে বসলেও তাকে খুব একটা পাত্তা দিতে নারাজ উৎসব নগরী। নিজস্ব আভিজাত্যে ঝলমল করছে বো বারাক। চাঁদনিচক মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে বউবাজার থানার পিছনের গলি দিয়ে খানিকটা এগলেই আয়তকার চাতাল। লাল ইঁটের পাঁজর নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। যার পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে দীর্ঘ ৮০ বছরের ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যদের জন্যই এই বারাকের পত্তন। কলকাতার বুকে এ এক অন্য কলকাতা। আয়তকার এই চাতাল ডিসুজা, ডিরোজিও, ক্রিস্টোফার অগাস্টিনের মহল্লা। এখানে ৩২টি পরিবারের বাস। ক্রিসমাস ট্রি, সান্তা ক্লজ, রং বেরঙের বেলুন আর আলোর মালায় সেজেছে গোটা মহল্লা। প্রায় আট দশকের ক্ষয়িষ্ণু ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও অমলিন বো বারাকের বড়দিন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পর এবার মহানগরের বড়দিনের ফেস্টিভালের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে বো বারাকও। এই বাড়তি পাওনার আনন্দেই এখন মশগুল গোটা মহল্লা। 

শুধু কলকাতা কেন, বড়দিন উপলক্ষে জেলায় জেলায় সাজো সাজো রব। বেশ কয়েকদিন ধরেই ঐতিহ্যবাহী ব্যান্ডেল চার্চ সাজানোর কাজ চলেছে। করোনার জন্য গত দু’বছর মন খুলে আনন্দে মেতে ওঠার উপায় ছিল না। এবার যেন সেই খেদ মিটিয়ে দিতে তৈরি ব্যান্ডেল চার্চ। বড়দিনকে সামনে রেখে এখানে ইতিমধ্যেই সেজে উঠেছে বাংলার অন্যতম ব্যাসিলিকা। তৈরি হয়েছে প্রভু যিশুর জন্মস্থান গোশালা। আমজনতার উন্মাদনার কথা মাথায় রেখে তা করা হয়েছে মূল গেটের পাশেই। প্রভল ভিড় সামাল দিতে ২৪ ডিসেম্বর রাতের প্রার্থনায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে মানুষের উপস্থিতির সংখ্যা। চার্চ প্রাঙ্গনে অবশ্য কোনও বিধিনিষেধ থাকছে না। আলো থেকে বাগানসজ্জা, সব প্রস্তুতিই চূড়ান্ত। তবে বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই ব্যান্ডেল চার্চে ভিড় জমতে শুরু করেছে। ভিড় সামাল দিয়ে চার্চের ভিতরে ঢোকার জন্য করা হয়েছে ওয়ান ওয়ে। ফাদার জন বলেছেন, করোনার কারণে দু’বছর মানুষ সেভাবে বড়দিনের উৎসবে অংশ নিতে পারেননি। তাই এবার তাঁরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। গত কয়েকদিন ধরে যেভাবে ভিড় হচ্ছে, তাতে আমরা সেটাই আঁচ করতে পারছি। বড়দিনের উৎসব উপলক্ষে গোটা চার্চ সাজিয়ে তোলা হয়েছে। তবে ২৪ ডিসেম্বর রাত ও ২৫ ডিসেম্বর কিছু বিধিনিষেধ বহাল রাখা হচ্ছে। সুষ্ঠুভাবে গোটা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করাই লক্ষ্য আমাদের। শুধু হুগলি নয়, গোটা দেশে এমনকী বিদেশেও ব্যান্ডেল চার্চের একটা আলাদা পরিচিতি রয়েছে। এই চার্চটির জন্মলগ্ন থেকেই জড়িয়ে রয়েছে নানা ঐশ্বরিক মহিমা। ইতিমধ্যেই তা ব্যাসিলিকার খেতাব পেয়েছে। সারা বছর তো বটেই, বড়দিনকে সামনে রেখে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয় এখানে।

বড়দিনে সেজে উঠেছে সীমান্ত শহর বনগাঁও। পুরসভার উদ্যোগে শহরের ত্রিকোণ পার্ক থেকে মতিগঞ্জ, বিএস ক্যাম্পের মোড়, সর্বত্রই চন্দননগরের বাহারি আলোয় সাজানো হয়েছে। পুরপ্রধান গোপাল শেষ বলেছেন, বছর শেষে মানুষ যাতে সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে আনন্দে মেতে উঠতে পারেন, সেজন্য গোটা শহরে উৎসবের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। বনগাঁ শহর এখন আলোর রোশনাইয়ে ভাসছে। বনগাঁর ছয়ঘরিয়ায় সেজে উঠেছে চার্চ। ক্যারল গানের মাধ্যের মাধ্যমে প্রভু যিশুর মুক্তির বাণী ছড়িয়ে দেওয়া হবে মানুষের মধ্যে। গির্জার ভিতরেই তৈরি করা হয়েছে গোশালা। বসেছে মেলা। হাজার হাজার মানুষ ভিড় করবেন এই গির্জায়। সেইমতো পুলিশ ও ভলান্টিয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।  

অনেকেই অবশ্য বলতে শুরু করেছেন চীনে যেভাবে করোনা ফের দাঁত নখ বের করতে শুরু করেছে, তাতে এখন থেকেই আমাদের ফের সজাগ হওয়া দরকার। সেক্ষেত্রে বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষের উৎসবকে সামনে রেখে এভাবে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তার ফল খুবই খারাপ হতে পারে। তখন আফশোস করেও কোনও লাভ হবে না। তার চেয়ে বরং এখন থেকেই ফের সামাজিক দূরত্ব বিধি চালু করা হোক। যাতে নতুন করে লকডাউনের পথে হাঁটতে না হয়। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, আমাদের যে টিকা নেওয়া আছে, সেটাই আমাদের অনেকটা রক্ষা করবে। কারণ, চীনে যে টিকা দেওয়া হয়েছে, তার তুলনায় ভারতে করোনা প্রতিরোধে যে টিকা দেওয়া হয়েছে, তা অনেক বেশি কার্যকরী।

এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভারতে ৯৬ শতাংশ মানুষ হয় কোভিশিল্ড নতুবা কো ভ্যাকসিন টিকা নিয়েছেন। চীনে দেওয়া হয়েছে করোনা ভ্যাক কিংবা সিনোফার্ম টিকা। ব্রাজিলে ১০ লক্ষ মানুষের উপর চালানো এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, করোনা ভ্যাক কিংবা সিনোফার্ম এবং কোভিশিল্ড ও কো ভ্যাকসিন টিকা তরুণদের উপর সমান কার্যকরী। কিন্তু বয়স্কদের ক্ষেত্রে গুরুতর সংক্রমণ প্রতিরোধে তা তুলনামূলকভাবে অনেক কম কার্যকর। তাছাড়া চীনে এই মুহূর্তে করোনার বাড়বাড়ন্তের পিছনে দায়ী ওমিক্রনের বিএফ-৭ নামে করোনা ভাইরাসের নয়া ভ্যারিয়েন্ট। আমাদের দেশে গত জুলাই মাসে একটি নমুনায় এই ভ্যারিয়েন্টটির খোঁজ মিলেছিল। কিন্তু গত ৩০ নভেম্বর থেকে যত নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, তার একটিতেও ওই ভ্যারিয়েন্টের খোঁজ মেলেনি। ফলে এখনই এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবশ্য বলেছেন, নাগরিক ও সরকার দু’পক্ষকেই সজাগ হতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মাথায় রেখে নিতে হবে বাড়তি উদ্যোগ। ভিড়ের মধ্যে মাস্ক পরে থাকতে হবে। যদিও এখনই তা আবশ্যিক করা হয়নি।

বড়দিন ও বর্ষশেষের উৎসবেও আত্মশৃঙ্খলার উপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর পরামর্শ, যাঁদের টিকার ডোজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, তাঁরা যেন দ্রুত তা নিয়ে নেন। বিশেষত কো মরবিড ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটা করা জরুরি। হাসপাতালে শয্যা, অক্সিজেন জোগান, ভেন্টিলেটর, জরুরি ওষুধের যাতে কোথাও ঘাটতি না থাকে, রাজ্যগুলির সঙ্গে সমন্বয় বাড়িয়ে তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ওষুধের দাম যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে। আইসিএমআরের প্রাক্তন এডিজি ডাঃ সমীরণ পাণ্ডা বলেছেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের চরিত্র হল তা দ্রুত ছড়ায়। কিন্তু ততটা মারাত্মকভাবে হামলা চালাতে পারে না। তাছাড়া ভারতে ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষের করোনা টিকার ডবল ডোজ নেওয়া হয়ে গিয়েছে। ফলে তাঁদের শরীরে হাইব্রিড ইমিউনিটি তৈরি হয়ে আছে। ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশে নতুন করে সংক্রমণ ছড়ালেও আমাদের দেশে এখনই ততটা ভয়ের কিছু নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here