দেশের সময় : আদতে ইতিহাসের ছাত্র। একটা সময় পরিবারের চাহিদা বলতে ছিল, পড়াশোনা শিখে জীবনে যা হোক একটা কিছু করা। ইতিহাসের মোটা বই মুখস্থ করতে করতে নদীয়ার সিলিন্দা গ্রামের সুমন রায়ও ভাবতেন, নিদেনপক্ষে একটা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেলেই বর্তে যাবে জীবনটা। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই রানাঘাট কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স, তারপর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ। ইতিহাসের শিক্ষক হওয়া হয়নি সুমনের। জীবনে ইউটার্ন নিয়ে তিনি হয়েছেন একজন সফল ব্যবসায়ী।
ইতিহাসের ছাত্রকে বাণিজ্যের নেশা ধরিয়েছিলেন সুমনের মেশোমশাই। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাননি সুমন। বরং মেশোমশাইয়ের ধরিয়ে দেওয়া নেশাটাকেই পেশা করে ফেলেন তিনি। সীমান্ত বাণিজ্যে ভর দিয়ে শুরু হয় তাঁর পথচলা। তারপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। একের পর এক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাণিজ্যের সুবাদে পা রাখা বিদেশের মাটিতে। বর্তমানে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, পশ্চিম আফ্রিকা, তুরস্ক, লাউস সহ অন্তত দশটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চলে সুমনের কোম্পানির।
বাণিজ্যে ভর করেই বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেন তিনি। একসময় খেলাধুলোর শখ ছিল। কিন্তু এখন নেশা বলতে একটাই। আর তা হল কাজ। দেশে কিংবা বিদেশে খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা সুমনের বরাবরের অভ্যাস। তারপর কিছুক্ষণ শরীরচর্চা। স্নান, ব্রেকফাস্ট সেরেই ডুবে যাওয়া কাজে।
তবে এরই মাঝে ‘দেশের সময়’ হাত ধরে এবার নয়া জার্নি সুমনের। কাজের ক্ষেত্রকে ক্যালেন্ডারে তুলে ধরার প্রয়াস।
দিনপঞ্জির ক্যানভাসে এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোল থেকে ঐতিহ্যবাহী কলকাতার খিদিরপুর ডক। নতুন বছরেই সেই আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটবে সেই ক্যালেন্ডারের।
একান্ত আলাপচারিতায় বললেন, অনেকেই জানেন না, সীমান্তে কীভাবে বাণিজ্য হয়। কত মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত। ক্যালেন্ডারে সেসবের টুকরো টুকরো কোলাজ তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। বন্দর নিয়ে ভবিষ্যতে তথ্যচিত্র তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে। বললেন, শুধু রোজগারের জন্য কাজ নয়। কাজ করতে হবে ভালবেসে। তাতেই লক্ষ্মীলাভ হবে।
সুমনের কথা যে পুরোপুরি ঠিক, তা জানান দিচ্ছে তাঁর ব্যবসার বহর। দু’টি কোম্পানি ছিল। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়াতে সদ্য পথচলা শুরু করেছে আরও একটি কোম্পানি। গত বছর দু’টি কোম্পানির টার্নওভার ছিল ৫৫ কোটি টাকা। এবার তা ছাপিয়ে যাবে বলে আশাবাদী সুমন।
২০০৫ সাল। মেশোমশাইয়ের হাত ধরে ঘোজাডাঙায় সীমান্ত বাণিজ্যে হাতেখড়ি হয় সুমনের। ধীরে ধীরে বুঝে নিতে থাকেন ব্যবসার খুঁটিনাটি। ২০০৭ সালে এসে নিজে একটা অফিস করেন। প্রথমে স্থল বন্দরের ক্লিয়ারিং এজেন্ট হিসেবেই কাজ করতেন। পরে রেলের কাস্টম ক্লিয়ারেন্সের কাজও শুরু করেন। ২০১২ সালে এক্সপোর্ট ইমপোর্টের পাশাপাশি লজিস্টিক সংস্থাও খুলে ফেলেন। ২০১৯ সাল, তখনও করোনা জাঁকিয়ে বসেনি।
ব্যবসার সূত্র ধরে মফস্বল থেকে সুমন পা রাখেন কলকাতায়। এতদিন স্থলবন্দরের কাজ করেছেন। এবার জলপথে বাণিজ্য করতে তৈরি করেন ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং লাইসেন্স। কলকাতার ফেয়ারলিপ্লেসে ডায়মন্ড হেরিটেজ বিল্ডিংয়ে প্রথমে ভাড়ায় একটি অফিস নেন। তারপর ওই ভবনেই নিজের অফিস হয়। খিদিরপুর বন্দরে কাজ শুরু করেন। তৈরি করেন সিয়াম লজিস্টিক প্রাইভেট লিমিটেড।
এবার লক্ষ্য বিদেশ। ভিয়েতনাম দিয়ে শুরু হয়। তারপর একের পর এক দেশ। সুমনের কোম্পানি আইএসও নথিভুক্ত। তাঁর সংস্থা গ্লোবাল লজিস্টিক অ্যালায়েন্সের (জিএলও) সদস্য। তিনি ফেডারেশন অফ এক্সপোর্ট ইন্ডিয়ান অর্গানাইজেশনেরও সদস্য। সংগঠনে বৈঠকে যোগ দিতে ফি বছর যেতে হয় বিদেশে। ঘুরে এসেছেন চীন, দুবাই, থাইল্যান্ড।
সীমান্ত বাণিজ্যে বিশেষ অবদানের জন্য গতবার কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সংস্থার তরফে পেয়েছেন বিশেষ পুরস্কার। এবার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্সে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চান।
সুমনদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল হোমিওপ্যাথির ওষুধ সরবরাহ। সেখান থেকে সীমান্ত বাণিজ্যে সাফল্য, পরিবার তো বটেই, সুমনের চেষ্টাকে কুর্নিশ জানান প্রত্যেকেই। আর সুমনের কথায়, আমি এখনও প্রতিনিয়ত শিখছি। নতুন কিছু জানতে বই পড়ছি। বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা শিখেছিলাম। এখন ইংরেজি বই পড়তে হচ্ছে। একসময় ক্লাসে ইতিহাসের বই পড়েছি। এখন কোম্পানি চালাতে শিখতে হচ্ছে অ্যাকাউন্টস।
সফল এই উদ্যোগপতির কথায়, আমার টিম নিয়ে আমি দারুণ খুশি। ওরা নিজেরাই সবটা চালিয়ে নিতে পারে। নতুন কিছু ভাবার জন্য সময় দেয় আমাকে।
বর্তমানে সুমনের পরিবার থাকে চাঁদপাড়ার কাছে মণ্ডলপাড়ায়। তবে ব্যবসার সূত্রে সেখানে সবদিন থাকা হয় না সুমনের। রাজারহাটে থাকেন তিনি।