গৌতম বুদ্ধের হাত ধরে শুরু হয়ে বৌদ্ধ ধর্মের পথ চলা। এই ধর্ম প্রেমের বাণীকেই প্রচার করা হয়েছে সব থেকে বেশি। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি ভালবাসা বিশ্বের সকলের রয়েছে, ভারতও তার বাইরে নয়! এদেশেই রয়েছে বুদ্ধগয়া, সাঁচী, সারনাথ, বারাণসী। বৌদ্ধধর্ম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে অহিংসার বাণী। ভারতের নানা প্রান্তে রয়েছে বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার, বৌদ্ধ মন্দির, মঠ যেখানে আজও শান্তির বাণী প্রচার করছেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা।
বৌদ্ধদের পবিত্র ধর্মস্থান তো বটেই, দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণের জায়গাও হল বুদ্ধগয়া। ২৩ মে, বৃহস্পতিবার বুদ্ধপূর্ণিমা। দেশের নানা বৌদ্ধ মঠে এই দিনটি উদ্যাপন করা হয়। তার মধ্যে বিহারের বুদ্ধগয়া একটি। এই মঠের মূল আকর্ষণ হল মহাবোধি মন্দির। যেখানে গৌতম বুদ্ধ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তাই বৌদ্ধদের কাছে এই মঠের বিশেষ গুরুত্ব আছে। বুদ্ধপূর্ণিমার পবিত্র দিনটিতে শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা নন, দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকেরাও ভিড় জমান এখানে।
গৌতম বুদ্ধ এই জায়গাতেই নির্বাণলাভ করেছিলেন এবং নির্বাণলাভের পরে সাতটি সপ্তাহ তিনি বিভিন্ন জায়গায় কাটান, যে জায়গাগুলো আজ দাঁড়িয়ে আছে মহাবোধি মন্দিরেরই চত্বরে। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে, সমস্ত প্রলোভনকে জয় করে নির্বাণলাভ করেছিলেন বুদ্ধ এবং তাঁর জীবনপথের অনেক চিহ্নই তিনি এই মন্দিরপ্রাঙ্গণে রেখে গিয়েছেন। যে গাছের নিচে বসে তিনি নির্বাণ লাভ করেন সেটাই বোধিবৃক্ষ নামে পরিচিত। বিহারে রয়েছে এই মন্দির, বহু তীর্থযাত্রী এখানে প্রতি বছরে আসেন। পঞ্চম শতকে মহারাজা অশোক এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন।
ইতিহাসের পাতায় এর নাম উরুভেলা। আঠারো শতকে ‘বোধগয়া’ নামে পরিচিতি পায় এই স্থান। মহাভারতে উল্লেখিত নিরঞ্জন নদীর পাড়ের এই ধর্মস্থানে প্রথম বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেন সম্রাট অশোক। ‘বোধিমণ্ড বিহার’ নামের সেই দেবালয় এখনকার অতি পরিচিত ‘মহাবোধি’ বৌদ্ধমন্দির। উনিশ শতকে স্যর আলেকজান্ডার কানিংহ্যামের নেতৃত্বে মন্দির পুনঃস্থাপনের কাজ শুরু হয়। ৫৫ মিটার উচ্চতার মন্দির চূড়া দেখা যায় প্রায় ১১ কিলোমিটার দূর থেকে।
বুদ্ধপূর্ণিমায় যদি বুদ্ধগয়ায় ঘুরতে যান, তা হলে মহাবোধি মন্দির ছাড়াও আরও নানা জায়গা আছে দেখার। জেনে নিন কোন কোন জায়গা দেখবেন।
সপ্তম শতাব্দীতে গুপ্তযুগে শেষ হয় পিপুল গাছের পূর্ব দিকে মহাবোধি মন্দির তৈরির কাজ। মন্দিরের ভিতরে সোনার জল করা কষ্টিপাথরের ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বুদ্ধের বসে থাকার মূর্তি তৈরি করেন পাল রাজারা। দিনের পড়ন্ত আলোয় মহাবোধি মন্দির চত্বরে বসে থাকলে, সত্যিই মন জু়ড়িয়ে যায়। এখন তো ওই মন্দির চত্বর জুড়ে তৈরি হয়েছে ৮০ ফুটের বুদ্ধমূর্তি থেকে শুরু করে অজস্র বৌদ্ধবিহার।
প্রার্থনাকক্ষ
ফল্গু নদীর পাড়ে একটি বট গাছের নীচে ‘তিন দিন তিন রাত’ ধ্যানমগ্ন ছিলেন তিনি। বোধিসত্ত্ব লাভ করার পর বুদ্ধদেব সাত সপ্তাহ ধরে সাতটি ভিন্ন স্থানে আবারও ধ্যান করেন। শোনা যায়, নির্বাণলাভের পর দ্বিতীয় সপ্তাহটি কাটিয়েছিলেন এই প্রার্থনাকক্ষে। এই স্থান ‘অনিমেষলোচন চৈত্য’ নামে পরিচিত।
রত্নগড় চৈত্য
নির্বাণলাভের পর চতুর্থ সপ্তাহটি এই স্থানে কাটিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বার থেকে উত্তর-পূর্বেই রয়েছে এই করত্নগড় চৈত্য।
চনক্রমনা
এই স্থানে নির্বাণলাভের তৃতীয় সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। কথিত আছে, ১৮ পা এগিয়ে ও ১৮ পা পিছিয়ে এই স্থানে এক সপ্তাহ সময় কাটিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ।
পদ্মপুকুর
ষষ্ঠ সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন পদ্মপুকুর চত্বরে। মূল মন্দিরের দক্ষিণে রয়েছে এই পবিত্র স্থান।
রাজ্যতন গাছ
গৌতম বুদ্ধের ধ্যানপর্বের শেষ সপ্তাহ কেটেছিল এখানে। এই স্থানের ধর্মীয় মাহাত্ম্য বোঝাতে এখানে একটি বৃক্ষরোপণ করা হয়। মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে এই স্থান।
আজপাল গাছ
গৌতম বুদ্ধের নির্বাণলাভের পঞ্চম সপ্তাহ কেটেছিল এই প্রাচীন গাছের নীচে। একটি সাদা পাথরের থালায় বার্মিজ শিলালিপিতে এই স্থানের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা আছে।
রাজায়তন
গৌতম বুদ্ধ তাঁর সপ্তম ও শেষ সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন এই স্থানে। এখান থেকেই তিনি সারনাথের উদ্দেশে যাত্রা করেন।
বুদ্ধের সাধনাস্থল ছাড়াও রয়েছে আরও দর্শনীয় স্থান। তাই মনাস্ট্রি, মুচলিন্দ লেক, রয়্যাল ভুটান মনেস্টারি, চিনা মন্দির, ভিয়েতনামিজ মন্দির, বার্মিজ বিহার মেস্টারি, সুজাতা মন্দির, সুজাতা কুটির, ইন্দোনেশিয়ান মন্দির, জাপানিজ মন্দির, দলাই লামা প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত ও ভারতের উচ্চতম বুদ্ধ মূর্তি।
সারনাথ একটি উদ্যান যেখানে গৌতম বুদ্ধ সর্বপ্রথম ধর্ম নিয়ে ভেবেছিলেন। এই স্থানটি ভারতের উত্তর প্রদেশের বারাণসী শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। আসুন দেখে নেওয়া যাক এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলো। ধামেক স্তূপ, ধর্মরাজিক স্তূপ, জাপানী বৌদ্ধ বিহার, চিনা মন্দির, ডিয়ার পার্ক, সারনাথ মিউজিয়াম। ধামেক তত্বরেই রয়েছে সম্রাট অশোকের বানানো ২০ মিটার উঁচু অশোক পিলার।
গোল্ডেন প্যাগোডা মন্দির, অরুণাচল প্রদেশ
হিমালের কোলে রয়েছে বুদ্ধের এই মন্দির। একে অনেক কং মু খামও বলেন। অরুণাচলের নামসাই জেলাতে রয়েছে এই বৌদ্ধ বিহার। ২০১০ সালে ২০ হেক্টর জায়গা নিয়ে তৈরি হয় এই মন্দির। বৌদ্ধ আর্কিটেকচারের অন্যতম এ সুন্দর একটি নির্দশন এই মন্দির।
ভারতের অন্যতম সেরা বৌদ্ধ বিহার হল এটি। পাহাড়ের কোলে বিরাজ করেন বুদ্ধ। এখানে রয়েছে সব থেকে বড় বুদ্ধ মন্দির, যার উচ্চতা ৪৯ ফুট। সারা পৃথিবী থেকে তীর্থযাত্রারা আসেন এখানে, বুদ্ধের এই মূর্তি দর্শন করতে।