দেশের সময়, কলকাতা: সরস্বতী পুজো  নিয়ে কথা বললেই মনে পড়ে যায় স্কুল জীবনের কথা। বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে সকাল সকাল পরিশুদ্ধ হয়ে দেবীর আরাধনায় নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে নিয়োজিত করা। কারণ, সেসময় শিশু মনের মধ্যে একটা মিথ কাজ করত দেবীর আরাধনায় কোনওরকম বিঘ্ন হলে পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল হবে না।

আজও ছোটদের মনে গেঁথে আছে সেই মিথ। কিন্তু একজন শিল্পীর চোখে সরস্বতী কেমন? তিনি কি শুধুই দ্বিভুজা, শ্বেতশুভ্র, বীণারঞ্জিত পুস্তক হাতে…। না, আমাদের দেখার বাইরেও দেবী সরস্বতীর আরও অনেক পরিচয় আছে। হাজারও নাম তাঁর। গোটা পৃথিবীতে তাঁকে নানা নামে ডাকা হয়। পুজো করা হয় ভিন্ন ভিন্ন রূপে। কোথাও তিনি চতুর্ভুজা, কোথাও আবার অষ্টভুজা। সরস্বতীর এই নানা রূপ রং তুলির ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী মোহিনী বিশ্বাস।

আগামী ২২ জানুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনী। দক্ষিণ কলকাতায় দেশপ্রিয় পার্কের কাছে আর্ট উইন্ডো গ্যালারিতে মোহিনীর প্রদর্শনী চলবে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। শিল্পীর কথায়, সরস্বতীকে নানা নামে যেমন ডাকা হয়, তেমনই তাঁর রূপও ভিন্ন। বেদে কীভাবে সরস্বতীর বর্ণনা করা হয়েছে, বৌদ্ধ শাস্ত্রেই বা সরস্বতীর মাহাত্ম্য কী, সবটাই ছবিতে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন তিনি। সঙ্গে মিশেছে তাঁর ভাবনা, শিল্পিসত্ত্বা। দর্শকদের জন্য ছবি কেনার সুযোগও থাকছে প্রদর্শনীতে। ছবি বিক্রির অর্থ দুঃস্থ পড়ুয়াদের পড়াশোনার জন্য দান করতে চান শিল্পী।

মোহিনীর কথায়, বাংলা ভাষায় সরস্বতীর অন্য নাম সারদা, বাগদেবী, বাগ্বাদিনী, বাগীশা, বাগদেবতা, বাগীশ্বরী, বাঙ্ময়ী, বিদ্যাদেবী, বাণী, বীণাপাণি, ভারতী, মহাশ্বেতা, শতরূপা, গীর্দেবী, সনাতনী, পদ্মাসনা, হংসারূঢ়া, হংসবাহনা, হংসবাহিনী, কাদম্বরী, শ্বেতভুজা, শুক্লা ও সর্বশুক্লা প্রভৃতি।

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী,  সরস্বতী শিক্ষা, সঙ্গীত, জ্ঞানের দেবী হিসেবে পরিচিত। সর্বপ্রথম ঋকবেদে দেবী সরস্বতীর উল্লেখ পাওয়া যায় এবং বৈদিক যুগে এই দেবীর গুরুত্ব তাৎপর্যপূর্ণ। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছাড়াও বৌদ্ধ এবং ভারতের কিছু অঞ্চলের জৈন ধর্মাবলম্বীরাও সরস্বতীর আরাধনা করে থাকেন।

তবে দেবী সরস্বতীর আরাধনা শুধুমাত্র ভারতকেন্দ্রিক নয়। বিশ্বব্যাপী মানুষ বাগদেবীর আরাধনায় ব্রতী হন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন দেশে এই দেবী বিভিন্ন নামে এবং রূপে পূজিত হন।

ইন্দোনেশিয়ার পাউকন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, বছরের শেষ দিনটি সরস্বতী পুজোর দিন হিসেবে পরিগণিত হয়। দেবী সরস্বতী শিক্ষার দেবী রূপে পূজিত হন। কথিত আছে, ভারতীয় হিন্দুরাই ইন্দোনেশিয়ায় এই পুজোর প্রচলন করেন। ভারতের মতো এখানেও পুজোর দিন ফুল, পবিত্র গ্রন্থের মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দেবীকে অর্চনা করা হয়। তবে এখানে হিন্দুরা কোনও সমুদ্রের তীরে বা কোনও পবিত্র জলাধারের কাছেই এই পুজো সম্পাদন করেন।

প্রাচীন থাই শাস্ত্র অনুসারে, দেবী সরস্বতী ভগবান ব্রহ্মার স্ত্রী হিসেবে পরিচিত। এখানে হিন্দু এবং বৌদ্ধ দুই ধর্মের একটা মিশ্র ধারণা মিলিয়ে দেবীর রূপ নির্মাণ করা হয়েছে। দেবী সরস্বতী এখানে বাকশক্তি এবং শিক্ষার দেবী হিসেবে পূজিত হন, আর দেবীর সঙ্গী হিসেবে ময়ূর বিরাজমান। থাইল্যান্ড ভ্রমণে গেলে প্রাচীন থাই ওয়াটগুলিতে হিন্দু দেব দেবীদের মূর্তি বিশেষত দেবী সরস্বতীর মূর্তি দেখা যায়।

নেপালে ও হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, মাঘ মাসের বসন্ত পঞ্চমী দিনেই দেবী সরস্বতীর আরাধনা করা হয়। এখানেও দেবী জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা এবং শিক্ষার দেবী হিসেবে পূজিত হন। তবে এখানে অভিভাবকরা তাদের শিশুদের প্রথম স্কুলে ভর্তি করার জন্য এই দিনটিকে বেছে নেন।

জাপানের সরস্বতী পুজোর ধারণার উদ্ভব ভারত থেকেই। কথিত আছে, প্রায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতক থেকেই এই পুজোর প্রচলন শুরু হয় । এখানে দেবী সরস্বতী বেনযাইতেন নামে পরিচিত। দেবীর দুই হস্তে ধারণ করে আছেন বিওয়া ( জাপানের একটি ঐতিহ্যবাহী যন্ত্র, যা মূলত সঙ্গীতের জন্য ব্যবহৃত হয় )। বেনযাইতেন এখানে সঙ্গীতের দেবী হিসেবে পরিচিত। জাপানের এনসীমা দ্বীপপুঞ্জের সাগামী বে, চিকুবু দ্বীপপুঞ্জের লেদ বিওয়া এবং ইতসুকুসীমা দ্বীপপুঞ্জের সেতো ইনল্যাণ্ড সমুদ্র নিকটবর্তী অঞ্চলে দেবী বেনযাইতেন এর বিশাল মূর্তি রয়েছে এবং প্রত্যেকদিন পুজো হয়।

কম্বোডিয়াতে দেবী সরস্বতীর উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। সপ্তম শতকের শাস্ত্রগুলিতে বিশেষত খেমের কবিদের রচনায় প্রথম এই দেবীর ধারণা পাওয়া যায় । তবে কম্বোডিয়ার দশম এবং একাদশ শতকের শাস্ত্র মতানুসারে অঙ্করিয়ান হিন্দুরাই প্রথম কম্বোডিয়ায় দেবী সরস্বতীর আবাহণ করেন। এখানে দেবী সঙ্গীত, লেখনী এবং অলঙ্কারশাস্ত্রের দেবী হিসেবে পরিচিত। এখানে দেবী সরস্বতী এবং ভগবান ব্রহ্মাকে একই সঙ্গে পুজো করা হয়।

মায়ানমারে দেবী সরস্বতীর রূপের ধারণাটা বৌদ্ধ আদলে নির্মিত। তবে ভারতীয় শাস্ত্র অনুসারে এখানেও তিনি শিক্ষার দেবী হিসেবে পূজিত হন। মায়ানমারে দেবী সরস্বতী থুরাঠাদি নামে পরিচিত, দেবীর দুই হস্তে রয়েছে পুস্তক এবং তিনি মায়ানমারের হাঁস জাতীয় কোনো পাখির উপর বিরাজমান। ভারতের মতো এখানেও ছাত্ররা পরীক্ষার আগে এই দেবীর আরাধনা করেন।

এই সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন রং তুলিতে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here