দেশের সময়: নজরে উত্তরবঙ্গ। আরও স্পষ্ট করে বললে পাখির চোখ উত্তরবঙ্গের চা বলয়। আর সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার থেকে তৃণমূলে নবজোয়ার কর্মসূচির সূচনা করেছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রামে ক্যাম্প করে থেকেছেন। মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। তাঁদের কথা শুনেছেন। একইসঙ্গে দলের কর্মীদের মানুষের সুখ-দুঃখে বিশেষ করে চা শ্রমিকদের আপদে-বিপদে পাশে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড। লক্ষ্য একটাই, চা বলয়ে দলের ভোটব্যাঙ্ক ফেরানো।
দীর্ঘ বাম শাসনে উত্তরবঙ্গের বঞ্চনা ঘোচেনি। কার্যত বিচ্ছিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দা হয়েই থেকে গিয়েছেন তাঁরা। ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গের উন্নয়নে জোর দিয়েছেন। উত্তরের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে বারবার তিনি ছুটে গিয়েছেন তরাই, ডুয়ার্স, পাহাড়ে। উত্তরবঙ্গবাসীর স্বপ্নপূরণে শিলিগুড়ির কাছে রাজ্যের মিনি সচিবালয় উত্তরকন্যা স্থাপন করেছেন। হাল ফিরেছে রাস্তাঘাটের। একাধিক মেডিক্যাল কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। রাজ্য সরকারের সমস্ত প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন উত্তরবঙ্গবাসীও। বন্ধ থাকা বহু চা বাগান খুলেছে। চা শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে অনেকটাই। কিন্তু তারপরও বিভিন্ন নির্বাচনে চা বলয়ে এসে ধাক্কা খেতে হচ্ছে জোড়াফুল শিবিরকে। মূলত অবাঙালি চা বলয় অধ্যুষিত অঞ্চলের ভোটে থাবা বসাচ্ছে বিজেপি। আর যেহেতু উত্তরবঙ্গে চা বলয়ের ভোট একটা বড় ফ্যাক্টর, ফলে সেই ভোট হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে উত্তরবঙ্গে ফল খারাপ হচ্ছে তৃণমূলের। এই ক্ষত মেরামত করতেই যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর এবার নিজের হাতে ব্যাটন তুলে নিলেন অভিষেক।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের যে জেলায় তৃণমূলের সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে, সেটি আলিপুরদুয়ার। এই জেলায় পাঁচটি বিধানসভা আসনের সবক’টিতেই পর্যুদস্ত হয়েছে তৃণমূল। এছাড়াও হাতছাড়া হয়েছে উত্তরবঙ্গের একাধিক আসন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আলিপুরদুয়ারে বেশিরভাগ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতির আসন এবং জেলাপরিষদ তৃণমূলের দখলে থাকলেও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকেই ধস নামতে শুরু করে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে যা ব্যাপক আকার নেয়। কিন্তু কেন? তা নিয়েই মাথাব্যথা শুরু হয় তৃণমূলের অন্দরে।
আলিপুরদুয়ারে যেমন চা বলয়ে ভোটের ফল খারাপ হয়েছে তৃণমূলের, তেমনই পাশের জেলা কোচবিহারে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার জোড়াফুল শিবির। বারবার দলের জেলা সভাপতি বদল করেও সেই দ্বন্দ্বে ইতি টানতে পারেনি তৃণমূল নেতৃত্ব। তারউপর বিজেপি আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার থেকে দু’জনকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করে দিয়েছে। ফলে গেরুয়া শিবিরের পায়ের তলার মাটি আরও শক্ত হয়েছে এই অঞ্চলে। সেকারণে আসন্ন পঞ্চায়েত ও আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে এখানে দলকে ভিত মজবুত করাই মূল লক্ষ্য অভিষেকের।
এককথায়, তৃণমূলে নবজোয়ার কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে চা বলয়ে দলকে ঘুরে দাঁড় করানোর চ্যালেঞ্জ নিলেন তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড। তিনিও যে আমজনতার ভিড়ে মিশে যেতে পারেন, তারও প্রমাণ করার চেষ্টা ছিল দলের এই কর্মসূচিতে। পাশাপাশি পঞ্চায়েতে টিকিট নিয়ে তৃণমূল যে কোনওরকম অস্বচ্ছতার পথ নেবে না, সেটাও এই কর্মসূচিতে স্পষ্ট করে দিয়েছেন অভিষেক। বুঝিয়ে দিয়েছেন, নিজের এলাকায় জনপ্রতিনিধি কে হবেন, তা ভোটদানের মাধ্যমে বেছে নেবেন গ্রামবাংলার মানুষ।
চা বাগান ঘেরা উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার। অসম সীমানার এই জেলার মানুষ অভিষেকের কর্মসূচি ঘিরে মেতে ওঠেন। অভিষেককে দেখার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। জনসভা থেকে পদযাত্রা, প্রতিটি কর্মসূচিতেই উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকও হাজার হাজার চা শ্রমিকের মন জয় করে নেন।
একদা কেএলওর ঘাঁটি কুমারগ্রামের বারোবিশার বিবেকানন্দ ক্লাবের মাঠে জনসভায় অভিষেক বলেন, বাম আমলে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ছিল মাত্র ৬৭ টাকা। ২০১১ সালের পর সেই মজুরি বাড়িয়ে ২৩২ টাকা করা হয়। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২৫০ টাকা। আমি মনে করি, চা শ্রমিকদের মজুরি আরও বাড়ানো উচিত। আমরা চা বাগানে ক্রেশ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র করেছি। ইতিমধ্যেই ৪২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ৭০টি ক্রেশ তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ছ’মাসের মধ্যে শেষ হবে।
বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি বারবার উত্তরবঙ্গকে অশান্ত করার চেষ্টা চালিয়েছে আগেও। তাদেরকে পিছন থেকে মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। তৃণমূলের অভিযোগ, উত্তরবঙ্গকে অশান্ত করতে গেরুয়া শিবির জাতপাতের রাজনীতিও করছে। কিন্তু তৃণমূল যে ভাগাভাগি চায় না, সবাইকে নিয়ে চলতে চায়, এবারের সফর থেকে সেই বার্তা দিয়েছেন অভিষেক। সম্প্রীতির বার্তা দিতে তিনি যেমন কোচবিহারের মানুষের আবেগ মদনমোহন মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়েছেন, তেমনই পুজো দিয়েছেন কুমারগ্রাম চা বাগানের শিবমন্দিরে।
আবার জলপাইগুড়িতে কর্মসূচির ফাঁকে তিনি মাজারে গিয়েছেন। সেখানে চাদর চড়িয়েছেন। মালা দিয়েছেন আদিবাসীদের বীরপুরুষ বীরসা মুন্ডার মূর্তিতে। মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন নেপালি সম্প্রদায়ের আদিকবি ভানুভক্তের মূর্তিতেও।
ডুয়ার্সের একপ্রান্ত যদি হয় আলিপুরদুয়ার, তাহলে অন্যপ্রান্ত মালবাজার। দুই জায়গাতেই কর্মসূচি করেছেন অভিষেক। তৃণমূলের প্রার্থী বাছাইয়ের পদ্ধতি নিয়ে কোচবিহারের পর আলিপুরদুয়ারেও দলীয় কর্মীদের মধ্যে খানিকটা অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। যদিও এসবে কোনও পাত্তা দিচ্ছে না তৃণমূলের হাইকমান্ড। অভিষেক স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিয়েছেন, চা বলয়ের ভোট ফেরাতেই হবে। আর সেই লক্ষ্যেই তাঁর এই কর্মসূচি।
দিনহাটার সাহেবগঞ্জ, সিতাই, গোসানিমারি আর মাথাভাঙা কলেজ মাঠে তৃণমূলের মিনি ভোট ঘিরে যে অশান্তির ঘটনা ঘটেছে, তার থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ের ওই ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় বদল এনেছে জোড়াফুল শিবির। কোচবিহার দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের ঘুঘুমারি হোমিওপ্যাথি কলেজের মাঠে অভিষেকের সভাস্থলে রাখা ছিল ব্যালট বাক্স। লাইনে দাঁড়িয়ে তৃণমূল কর্মীরা তাঁদের পছন্দের প্রার্থীর নাম লিখে জমা দিয়েছেন সেই বাক্সে। একসময় ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায়। সাদা কাগজেই নাম লিখে জমা দেন অনেকেই।
উত্তরবঙ্গ সফরে একদিকে যেমন মানুষের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন অভিষেক, দলকে শক্তিশালী করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, তেমনই রাজনৈতিকভাবে বিজেপিকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি। কোচবিহারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের গড়ে দাঁড়িয়ে মানুষকে প্রশ্ন করেছেন, আমি তো আপনাদের গ্রামে তাঁবুতে তিনদিন কাটিয়ে গেলাম। আপনারা ভোট দিয়ে এখান থেকে যাঁকে সাংসদ বানিয়েছেন, তাঁকে ক’দিন এলাকায় দেখেছেন?
শুধু তাই নয়, কোচবিহার দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ককে নিশানা করে নাম না করে তাঁর তোপ, একজন তো বিধানসভায় গিয়ে দু’মিনিটের মধ্যে ওয়াকআউট করে বেরিয়ে এসেই কলকাতায় ‘ফুর্তি’ করছেন। মানুষের জন্য কাজ করার সময় কোথায় তাঁর। একই কথার রেশ টেনে বানারহাটের গয়েরকাটার সভা থেকে অভিষেক বলেছেন, জলপাইগুড়ি জেলায় তো বিজেপির চারজন বিধায়ক, একজন সাংসদ রয়েছেন। কিন্তু মানুষের জন্য কী কাজ করছেন? সবাই সবটা দেখছে। সময় হলেই জবাব দেবেন মানুষ।
অভিষেককে দেখার জন্য গয়েরকাটা চৌপথি, সোনাখালি মাজারের সামনে ভিড় জমান বহু মানুষ। রেড ব্যাঙ্ক চা বাগান, গ্রাসমোড় থেকেও বহু চা শ্রমিক যোগ দিয়েছিলেন তাঁর সভায়। দক্ষিণ গোঁসাইয়ের হাট, মল্লিকশুভা, আঙরাভাসা, ঠাকুরপাঠ, দেওমালির মানুষেরও ভিড় ছিল অভিষেকের যাত্রাপথে।