আরজিকর কাণ্ড। এখনও কিছু কথা বলার বাকি। হ্যাঁ, এটা নিসন্দেহে ঠিক, কুৎসিত ঘটনা। জঘন্য ঘটনা। সিবিআই তদন্ত করছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, দিশা দেখা যাচ্ছে কোথায়? রাজনীতিকরা হাতা গুটিয়ে নেমে পড়েছেন ময়দানে। আমরা সাধারণ মানুষ বড্ড বোকা। বুঝতেই পারছি না, কীভাবে বিচারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন বদলে যাচ্ছে চেয়ার দখলের আন্দোলনে।
একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, রাজনীতির রং বদলায়। কিন্তু আমজনতা সেই তিমিরেই থেকে যায়। আমাদের বদল চাইতে হবে সিস্টেমের। কারণ, শক্তির আড়ালেই জমা হয়েছে জঞ্জাল। সেই জঞ্জাল সবার আগে সাফাই করতে হবে। ডাক্তারদের কাছে আর্জি, আপনাদের আন্দোলন হাইজ্যাক হতে দেবেন না। ভোটে জিতে বিধায়ক, সাংসদ হওয়ার পর সব দলের নেতারাই বলে থাকেন, জনগণের জয়। কিন্তু পাঁচবছর ধরে আসলে ক্ষমতা ভোগ করেন তাঁরাই। আমাদের জনগণের প্রশ্ন করার সময় এসেছে, সাধারণ মানুষের হাতে আর কবে ক্ষমতা আসবে?
আরজিকর কাণ্ড নিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুখে তারা যাই বলুক না কেন, রাস্তায় নেমে রঙ্গ তামাসা করছেন। শাসক দল নিজেকে বাঁচাতে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। আর বিরোধীরা আক্রমণ করবে এ আর নতুন কথা কী? কিন্তু এই টানাপোড়েনে আন্দোলনের অভিমুখ গৌণ হয়ে যাবে না তো? মানুষ কিন্তু দেরিতে হলেও বুঝতে পারছে। তারা অরাজনৈতিক থাকতে চাইছে। কারণ, মানুষের মধ্যে বিরক্তি ধরে গিয়েছে। কলকাতায় গত কয়েকদিনের মধ্যে দু’টি ঘটনা সামনে এসেছে। এক, গড়িয়াহাটে আরজিকর কাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলন চলছে।
রাস্তায় যানজট। আটকে থাকা বাসের ভিতর থেকে হাততালি দিচ্ছেন এক যাত্রী। দুই, আরজিকরে নিহত ডাক্তারের ছবিতে ফুল দিচ্ছেন রোগীর পরিজন। এই ছবি কিন্তু বিরল। তৃণমূল সাংসদ কাকলী ঘোষদস্তিদার মুখ খুলেছেন। বলেছেন, বাম আমল থেকেই কোলে বসিয়ে ডাক্তারি ছাত্রীদের পরীক্ষা নেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়। শুরু হয় অর্থনৈতিক বিনিময়। সেখান থেকে উৎকোচ। এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন, গত ১৩ বছর রাজ্যে সরকারে তৃণমূল। তাহলে এই সিস্টেমের কী সংস্কার হয়েছে?
যদি না হয়ে থাকে, কেন তা হয়নি? তবে এটা ঠিক, আরজিকর কাণ্ডের প্রতিবাদে যেদিন প্রথম আন্দোলন শুরু হয়, সেদিন মূল দাবি ছিল বিচারের। কিন্তু এখন আন্দোলন যে পথে পরিচালিত হচ্ছে, তাতে মূল দাবি দাঁড়িয়েছে চেয়ারের। চেয়ার কখনও বিচারের সামঞ্জস্য হতে পারে না। ফলে ঘোলা জলে মাছ ধরার এই চেষ্টা অবিলম্বে বন্ধ হোক। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ধর্ষকদের সাজা দেওয়ার জন্য নতুন আইন চান। কঠোরতম আইন। যাতে ধর্ষকদের ফাঁসি হয়।
ভালো কথা। কিন্তু শুধু আইন আনলেই তো হবে না। শক্তির আড়ালে যেসব আগাছা তৈরি হয়েছে, সেগুলোকে উপড়ে ফেলতে হবে সমূলে। কার ইন্ধনে ধৃত সিভিক সঞ্জয় রায় কলকাতা পুলিশ কমিশনারেটের নামে রেজিস্ট্রার করা বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াত? কেন তাকে এই প্রশ্রয় দেওয়া হত? কার হাত ছিল সঞ্জয়ের মাথায়? আন্দোলনরত ডাক্তারদের উদ্দেশেও একটি কথা বলার আছে, মনে রাখবেন সাধারণ মানুষ কিন্তু আপনাদের ভগবান মনে করেন।
কারণ, মানুষের বাঁচা মরার অনেকটাই নির্ভর করে আপনাদের উপর। তাই পরিষেবা বন্ধ করে আপনারা যেভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে কোথাও হলেও সাধারণ মানুষের মনে আপনাদের সম্পর্কে ইমেজটা টলে যেতে পারে। অবশ্যই আপনারা আন্দোলন চালাবেন। কিন্তু রিলে আন্দোলন করুন। পরিষেবাও দিন। আন্দোলনও চলুক। মনে রাখবেন, সরকারি হাসপাতালে কিন্তু বড়লোকরা আসেন না। আসেন খেটে খাওয়া গরিব মানুষ। সম্প্রতি এক চিকিৎসক নাকি এমন উক্তি করেছেন, এক হাজার রোগী মরে মরুক। আমার চেয়ার চাই। সত্যিই যদি তিনি এমন মন্তব্য করে থাকেন, তাহলে তাঁর গোপন এজেন্ডা কিন্তু ফাঁস হয়ে গিয়েছে।
এটাই ঘোলা জলে মাছ ধরা। এই অপচেষ্টা বন্ধ হোক। সম্প্রতি একটি তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে, গোটা দেশে বিজেপির দু’জন এমপি এবং ১৪ জন এমএলএ রয়েছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। সোনাজয়ী কুস্তিগীররা অভিযোগ করলেন, তাঁদের শ্লীলতাহানি করা হয়েছে। অভিযোগ বিজেপি এমপি’র দিকে। অথচ, তা নিয়ে কোনও হইচই হল না। বরং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের ছবিও দেখা গেল পরবর্তীতে। মাথায় রাখতে হবে, আরজিকর অবশ্যই একটা নিন্দনীয় ঘটনা। কিন্তু এটাই প্রথম নয়। কোচবিহারে কর্তব্যরত নার্সকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল।
বাম আমলে ধানতলা, বানতলা ঘটেছে। রাজ্যের বাইরের কথা বলতে গেলে উন্নাও, হাতরাস হয়েছে। ওড়িশায় রোগীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। সুতরাং এটা একটা সামাজিক অপরাধ। সার্বিকভাবে এই অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আরজিকর কাণ্ডের তদন্ত করছে সিবিআই। উপরে মনটরিং করছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু সিবিআইকে দেখে মনে হচ্ছে, তারা যেন ইঁদুর-বেড়াল খেলা খেলছে। সন্দীপ ঘোষ প্রতিদিন সিবিআই দফতরে যাচ্ছে সকালে। আর বেরিয়ে আসছে সন্ধ্যায়। উইক ডে’তে সন্দীপ সিবিআই অফিসে যাচ্ছেন। আর রবিবার সিবিআই আসছেন সন্দীপের বাড়িতে। সেদিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম থাকছে কি না জানা নেই, এমনই মন্তব্য করেছেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। প্রশ্ন হল, সন্দীপ যদি ঘটনায় জড়িত থেকে থাকেন, তাহলে গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন তাঁকে? কলকাতা পুলিশ তো তিনদিনের মধ্যে তাও একজনকে গ্রেফতার করেছিল। দু’সপ্তাহ ধরে সিবিআই কি করল?
মোদ্দা কথা হল, আমরা বড় দুঃসময়ের মধ্যে রয়েছি। আমজনতা বড় অসহায়!