‘ঈদজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ এলো আবার দুসরা ঈদ, কোরবানি দে কোরবানি দে শোন খোদার ফরমান তাকিদ।।’ -কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কাব্যসুর আকাশ-বাতাস মন্দ্রিত করে মনপ্রাণ উজালা করে তুলছে ঈদের আনন্দ উচ্ছ্বাসে। আল্লাহ তায়ালার প্রতি অপার আনুগত্য এবং তাঁরই রাহে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের এক ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে মুসলিম বিশ্বে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়ে আসছে। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগ ও অনুপম আদর্শের প্রতীকী নিদর্শন হিসেবে এই ঈদের রেওয়াজ। আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে প্রিয়বস্তু কোরবানি করার নির্দেশ পেয়ে প্রথমে ১০০ দুম্বা ও পরে ১০০ উট কোরবানি করার পরও একই নির্দেশ পাওয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েন হজরত ইব্রাহিম (আ.)৷ অবশেষে উপলব্ধি করেন- তাঁর সবচেয়ে প্রিয় তো পুত্র ইসমাইল। অতঃপর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজরত ইসমাইলকেই (আ.) কোরবানি করতে উদ্যত হন তিনি। পুত্র ইসমাইল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি হতে রাজি হয়ে যান। কিন্তু মহামহিম আল্লাহ রব্বুল আলামিনের অপার কৃপায় হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়। তা দেখে ইব্রাহিম (আ.) বিচলিত হয়ে পড়লে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দেন, পিতা-পুত্রের আত্মোৎসর্গের এই প্রচেষ্টাকে তিনি আত্মোৎসর্গের নিয়ত হিসেবে কবুল করে নিয়েছেন। এ জন্যই পিতার হাতে পুত্রের কোরবানি হতে না দিয়ে বেহেশত থেকে দুম্বা পাঠিয়ে কোরবানি হিসেবে কবুল করে নিয়েছেন। এই অনন্য ঘটনার স্মরণে কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা প্রচলিত হয়।
ত্যাগের মহিমায় চিরভাস্বর পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে আগামীকাল সোমবার৷ হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে জিলহজ মাসের ১০ তারিখে এ ঈদ উদযাপিত হয়। সে অনুযায়ী ভারত, বাংলাদেশ ও এর প্রতিবেশি দেশগুলোতে কাল জিলহজ মাসের ১০ তারিখ হবে৷ ঈদুল আজহা ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব। ধর্মীয় বিধান অনুসারে এ ঈদে পশু কোরবানি করা হয় বলে সবার কাছে ‘কোরবানির ঈদ’ বা ‘বাকরিদ’ নামেই পরিচিত।
এই ঈদে সামর্থ্য অনুযায়ী উট, মহিষ, দুম্বা, ছাগল ও ভেড়া কিনে কোরবানির মাধ্যমে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয় সবাই। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মেতে ওঠে ঈদ আনন্দে৷
আরবি ‘কুরবান’ শব্দ থেকে কোরবানি। এর অর্থ—ত্যাগ, উৎসর্গ, বিসর্জন, নৈকট্যলাভ ইত্যাদি। পরিভাষায় একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দিনে, নিদিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট ব্যক্তির পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট পশু জবেহ করাকে উযহিয়্যা বা কোরবানি বলে। স্বাধীন, বালেগ, বিত্তবান তথা মালেকে নেসাব, মুকিম, মুসলমানের পক্ষে তার নিজের কোরবানি করা ওয়াজিব। মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে জবাই করা পশুর মাংস বা রক্ত কিছুই পৌঁছায় না, কেবল আল্লাহভীতির পূর্ণ আন্তরিকতা সহকারে তার আদেশ পালন করার নিয়ত ছাড়া। এ প্রসঙ্গে কুরআনের সুরা হজে বলা হয়েছে—‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না সেগুলোর গোশত এবং রক্ত, বরং তার কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া-পরহেজগারি বা আল্লাহভীতিই।’ ’ঈদুল আজহার অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে, মনের পশু অর্থাৎ কুপ্রবৃত্তিকে পরিত্যাগ করা।’ মনের পশুরে কর জবাই পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই…’। মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রয়োজনে নিজের প্রিয় বস্তুকে কোরবানি দেওয়ার প্রস্তুতির শিক্ষাই এ ঈদের আদর্শ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দ্বিধাহীনভাবে তার কাছে আত্মসমর্পণ এবং তার নির্দেশ শর্তহীনভাবে মেনে নেওয়াই হলো ঈদুল আজহার প্রকৃত শিক্ষা। আল্লাহর রাহে পশু কোরবানি করে সেই ত্যাগের কথাকেই স্মরণ করা হয়। কোরবানিকৃত পশুর তিন ভাগের এক ভাগ গরিব-মিসকিন, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হয়। আবার পুরোটাই বিলিয়ে দেওয়া যায়।
এদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৬ জুন রোববার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠির মাধ্যমে মোদির শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন।
ভারতীয় হাইকমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।
চিঠিতে মোদি উল্লেখ করেছেন, এই উৎসবটি আমাদের ত্যাগ, সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যা একটি শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব গড়তে অপরিহার্য। ঈদুল আজহাকে বহু-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেও বর্ণনা করেছেন তিনি। একই সঙ্গে পাঠানো ওই বার্তায় শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।