International Day of Play আন্তর্জাতিক খেলা দিবস আজ, শিশু-কিশোরদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার পরিবেশ আছে কি? একালের শিশু-কিশোররা কতোটুকু আগ্রহী খেলাধুলায়?

0
96

আন্তর্জাতিক খেলা দিবস হল জাতিসংঘের বিশেষ পালন দিবসের সর্বশেষ সংযোজন। 25 শে মার্চ, 140 টি দেশের সমর্থনে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ 11 জুনকে আন্তর্জাতিক খেলা দিবস হিসাবে চিহ্নিত করে একটি রেজুলেশন পাস করে, যা শিশুদের খেলার অধিকার রক্ষার প্রচেষ্টা, এটিকে অন্যান্য মৌলিক অধিকারের সাথে সংযুক্ত করে।

ইরফান রহমান, ঢাকা:

মার্বেল খেলা, বউচি, নারকেলগাছের পাতা দিয়ে হাতঘড়ি–চশমা বানানো, গাছের ফুল–পাতা ছিঁড়ে ছোট্ট হাঁড়িতে রান্নাবাটি— খেলাগুলোর কথা মনে পড়লে হুড়মুড় করে স্মৃতিরা এসে ভিড় করে, সঙ্গে শিশুবেলার খেলার সাথীদের মুখ ভেসে ওঠে মনের আঙিনায়। যারা হয়তো সঙ্গী না হলে পুঁইফলের রং দিয়ে আঁকিবুঁকি, আর খেজুরগাছের পাতার চরকি নিয়ে দৌড়ানোর আনন্দ পূর্ণতা পেত না। গোল্লাছুট, কুতকুত, দাঁড়িয়াবান্ধা, কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলাগুলো সম্ভবই হতো না।
সন্তানেরা এখন কতটা খেলাধুলা করে, সেটা বলতে গিয়ে কয়েকজন অভিভাবকের মুখে এমন স্মৃতিচারণার উন্মেষ। সেই সঙ্গে তাঁদের কণ্ঠে আফসোস। কারণ, নিজেদের সন্তানেরা এখন এমন খেলায় মাতার সুযোগ পায় না। সঙ্গী বা খেলার জন্য খোলা জায়গা পায় না। এসব খেলার অনেকগুলো এখনকার শিশুরা চেনেও না। তা ছাড়া তাঁরা নিজেরাও ‘আগে পড়ালেখা, তারপর অন্যকিছু’ এই চাপে রাখেন শিশুদের। ফলে পড়ালেখার চাপের মধ্যে খেলার গুরুত্ব হারিয়ে যায়। অন্যদিকে শ্রমজীবী শিশুদেরও শৈশব ছেঁটে ফেলা হচ্ছে ছোট্ট কাঁধে সংসারের দায় চাপিয়ে। কোথাও যেন দম ফেলারও ফুরসত নেই শিশু-কিশোরদের৷

দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডে অব প্লে (আইডপ) গ্লোবাল নেটওয়ার্কের  ‘দ্য পাওয়ার অব প্লে’ (খেলার শক্তি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি তিনজনের একজন শিশু খেলার জন্য যথেষ্ট সময় পায় না। প্রতি পাঁচজনের একজনের খেলার নিরাপদ জায়গা নেই। প্রতিবন্ধী শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতি তিনজনের একজনের খেলার সঙ্গী নেই৷ বিশ্বের ২১টি দেশের ৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১০ হাজারের বেশি শিশুর মতামতের ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদনটি এ বছর প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়াও ভারতের শিশু-কিশোরদের সাথে কথা বলে একটি জরিপ করে সংস্থাটি, যাতে জিজ্ঞেস করা হয় কোথায় তারা খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে৷ ৬৬ শতাংশ শিশু-কিশোর নিজেদের বাসায় ইনডোর গেমসে স্বাচ্ছ্যন্দ্যবোধ করে বলে জানায়৷ এছাড়াও প্রকৃতি সংস্পর্শে ৩৭ শতাংশ, বিদ্যালয়ে ৫২, অনলাইনে ৪৪ শতাংশ শিশু-কিশোর খেলতে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পায়৷ শিশুদের জীবনে খেলাধুলার গুরুত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ ও মেধা বিকাশের প্রতি জোর দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আজ ১১ জুন প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ডে অব প্লে বা আন্তর্জাতিক খেলা দিবস। এ বছরের ২৫ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৪০টিরও বেশি দেশের সম্মতিতে নতুন এই দিবস ঘোষণার প্রস্তাব গৃহীত হয়। দিবসটি পালনে আইডপ নেটওয়ার্কের সমন্বয় করছে দ্য লেগো ফাউন্ডেশন।

চিকিৎসক নুসরাত হক ও করপোরেট কর্মকর্তা মমিনুল হক দম্পতি একমাত্র সন্তান নিয়ে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গ্রীন রোডে বাস করেন৷ কন্যা আয়াত নূর হকের বয়স ৮ বছর, তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী৷ মা নুসরাত হক দেশের সময়কে বলেন, টিউশন, হোমওয়ার্ক, ড্রয়িং ক্লাস, স্কুলের নিয়মিত ক্লাসের ফাঁকে অবসর পাওয়া একটি বড় বিষয়। যতটুকু সময় পায় ওই মোবাইল ফোনেই থাকতে পছন্দ করে। তাঁরা বাড়ি ফিরে রাতে সন্তানের সঙ্গে কিছুটা খেলেন। কিন্তু বাচ্চা খোলা জায়গায় সঙ্গীদের সঙ্গে খেলতে চায়। খোলা জায়গা না থাকা ও নিরপত্তাহীনতার কারণে তিনি সন্তানকে সেই সুযোগ দিতে পারেন না। ঠিক এমনটাই বললেন দুই সন্তানের মা-বাবা উম্মে সালমা পর্না ও তানবীন আহমেদ৷ এক কন্যা রায়তা (৯) ও পুত্র রোশান (৪), ছোট্ট এই বাচ্চারাও ক্রমাগত আসক্ত হয়ে যাচ্ছে মুঠোফোনের বন্দীখানায়৷ শহুরে জীবনে খেলার পরিবেশ ও মাঠ অনেকটাই কম৷ পড়ালেখার প্রচুর চাপ, বিদ্যালয়গুলোর অপরিকল্পিত সিলেবাস যাতে খেলাধুলাকে একপেশে করে ফেলা হয়েছে, আর খেলার সঙ্গীর অভাবে বাচ্চারা মুঠোফোন, ট্যাব তথা গ্যাজেটে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ কোনো কোনো অভিভাবকের মতে, খেলাধুলার সুযোগ না পেতে পেতে গ্যাজেটে খেলার চক্রে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে শিশুরা। যার ফলে গ্রামে মাঠ থাকার পরও অনেক শিশু-কিশোরেরা মুঠোফোনেই বুঁদ হয়ে থাকে।

রিয়াজ আহমেদ হিমেল, পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার৷ তিনি দেশের সময়কে বলেন, তাঁর ১৫ ও ১১ বছরের দুই পুত্র সন্তান ওয়ালিদ আহমেদ ও ওয়াফি আহমেদকে শহরের স্টেডিয়ামে ছুটির দিনে খেলার জন্য ভর্তি করেছিলেন। তবে খেলার ফি ১ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৭ হাজার টাকা হওয়ায় সেটা বন্ধ করে দিয়েছেন। বাসায় লুডু, দাবা, রুবিকস কিউব কিনে দিয়েছেন। এছাড়াও বাসার সামনে একটু জায়গা আছে যেখানে শর্ট পিচ ক্রিকেট খেলা যায়৷ কিন্তু এ খেলাগুলো সন্তানদের কাছে এখন খুবই সাদামাটা লাগে। এর চেয়ে তারা মুঠোফোন, ট্যাব, কম্পিউটারের ভার্চুয়াল জগতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে ও আনন্দ পায়। পড়ালেখার পর যতটুকু ফুরসত পায়, তারা গ্যাজেটেই ডুবে থাকে।

আইডপের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারও খেলার সময় নেই। কারও খেলার অনুমতি নেই। কারও খেলাধুলা করার মতো অবকাঠামো নেই। এশিয়ার ২০ শতাংশ শিশুর খেলার অনুমতি নেই। আমেরিকা ও ইউরোপে এ হার ১০ শতাংশ এবং আফ্রিকায় ২৮ শতাংশ। শিশুদের খেলতে চাওয়ার আগ্রহ কতটা এবং শিশুমনে খেলার প্রভাব কতটা সেটাও উঠে এসেছে এই জরিপে। ৯৭ শতাংশ শিশু জানিয়েছে, খেলা তাদের জন্য জরুরি। ৭১ শতাংশ জানিয়েছে, খেলা তাদের আনন্দ দেয়। ৫৭ শতাংশ মনে করে, খেলার মাধ্যমে তাদের বন্ধু তৈরি হয়। ৪৫ শতাংশ জানিয়েছে, খেলার মাধ্যমে মা–বাবা ও পরিবারের সদস্য এবং যিনি তাদের যত্ন নেন (কেয়ারগিভার) তাঁদের সঙ্গে সময় কাটাতে, খেলতে ভালোবাসে।

বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ বিভাগীয় শহর বরিশাল৷ এখানকার একজন শিক্ষক, আবৃত্তিকার ও শিশু-সংগঠক নিগার সুলতানা রহমান৷ তিনি বলেন, ‘আমরা ছোটোবেলায় যেভাবে এ পাড়া থেকে ও পাড়া ঘুরে আনন্দ করে বেড়াতাম, সঙ্গীরা একসাথে খেলতাম, এখন সেই চল কমে গেছে একেবারেই৷ শিক্ষার পরিবেশটাকে আরও শিক্ষার্থীবান্ধব করা দরকার৷ পড়ালেখার বিস্তর পাঠ্যক্রম চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে প্রচুর প্রেশার ক্রিয়েট করা হচ্ছে শিশু-কিশোরদের ওপর৷ এই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে আনন্দের মাঝে খেলতে খেলতে শেখা, শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা বিধান করা, প্রতিটি এলাকায় খেলার মাঠ ও কমিউনিটি স্পেসের ব্যবস্থা করা -এগুলোর ওপর জোর দিলে শিশু-কিশোররা সুস্থ ধারায় বেড়ে উঠবে৷ গ্যাজেটের প্রতি অত্যধিক মাত্রায় আসক্তি এখনকার বাচ্চাদের মেধা ও মননকে অনেকটা রোবটের মতো বানিয়ে ফেলছে, শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য নিঃশেষ করে দিচ্ছে৷ বাচ্চাদের গ্যাজেটের প্রতি আসক্তি কমাতে বাবা-মায়েদের উচিত, বাচ্চাদের যতোটা সম্ভব পারা যায় সময় দেওয়া, গল্প-কবিতার বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করা, সুস্থ ধারার সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করানো ও চর্চা করা, এগুলো অত্যাবশ্যক৷’

বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের মাঝে খেলতে খেলতে আনন্দ করা ও বইপড়া আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ রবীন আহসান৷ বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে ‘বইবাড়ি’ প্রতিষ্ঠা করার কাজ শুরু করেছেন তিনি৷ ইতোমধ্যে মানিকগঞ্জ এলাকাতে বইবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ কথা হয় তাঁর সঙ্গে, ‘দক্ষিণ এশিয়ার শিশু-কিশোরদের মাঝে গ্যাজেট আর সোশ্যাল সাইটস যেমন ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম ব্যবহার মহামারির মতো হয়ে গেছে৷ এটা এখন আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে৷ এ কারণে শিশু-কিশোরদের মেধার বিকাশটা প্রচণ্ডভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ যতোটা সম্ভব পারা যায়, বাচ্চাদের জন্য নিরাপত্তা বিধানের সাথে খেলাধুলার ব্যবস্থা করাটা অত্যন্ত জরুরি বর্তমানের প্রেক্ষাপটে৷ বাচ্চারা তো এমনিতেই স্কুলের বই অনেক পড়ছে৷ পড়ছে বলতে একগাদা গাইড, বই মুখস্ত করতে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে৷

এতে করে বাচ্চাদের প্রকৃত বিকাশ বলতে যা বুঝায়, তা কিন্তু হচ্ছে না৷ ফলে অনেক বাচ্চারাই বড় হয়ে ঝরে যাচ্ছে৷ বাচ্চারা আনন্দের সাথে বই পড়বে৷ অনেক বাচ্চারা একসাথে চলবে, কথা বলবে, একে অপরের ভাবের আদানপ্রদান করবে, এরকম অরগানাইজেশান থাকা দরকার, বিদ্যালয়গুলোতেও এরকম পরস্পর মিথস্ক্রিয়ার ব্যবস্থা করানো জরুরি৷ ধরুন একটা বিল্ডিংয়ে বিশটা ফ্ল্যাট৷ প্রতিটা ফ্ল্যাটে যদি দু’জন করে শিশু থাকে, তবে চল্লিশজন শিশু হয়৷ আমরা কিন্তু এদের এক করার কোনো ইনিশিয়েটিভ নিই না৷ আমাদের উচিত এই বাচ্চাগুলোকে এক করা৷ এরা একসাথে থাকবে, গল্প করবে, খেলবে৷ ছড়া, কবিতা, গান এরকম কর্মকাণ্ডে এদের যুক্ত করতে হবে৷ খেলার জন্য মাঠের ব্যবস্থা করে দিতে হবে৷ এতে করে তারা একাকিত্বে ভুগবে না৷ তাদের বিকাশটা সুন্দরভাবে হবে৷ পরিকল্পিত নগরায়ন দরকার যাতে করে খেলার পরিবেশ সব জায়গাতে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়৷’

Previous articleSupreme Court On NEET-UG 2024: পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন,নিটে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থার জবাব তলব সুপ্রিম কোর্টের
Next articleAn interview with Debadrito Chattopadhyay , a renowned Rabindra Sangeet Singer থিয়েটারের শহর গোবরডাঙায় রবীন্দ্র সঙ্গীতে মগ্ন দেবাদৃত চট্টোপাধ্যায়ের একান্ত সাক্ষাতকার: দেখুন ভিডিও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here