আপির্তা বনিক ও অঙ্কিতা বনিক, দীঘা : মনে পড়ে? ছোটবেলায় একটা সময় গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটির মানেই ছিল সদল বদলে সপরিবারে ঘুরতে যাওয়া? আর ঘুরতে যাওয়ার কথা উঠলেই উঠে আসত দীঘার নাম। শুধু গ্রীষ্ম, বর্ষা বা শরৎকাল কেন, অফিস ট্যুর বলুন, কলেজের বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে প্রথমবার বাবা মা ছাড়া বেড়াতে যাওয়া, এমনকী বাঙালির আদি এবং অকৃত্রিম হানিমুন ডেস্টিনেশনও ছিল এই দীঘা।আর এই দীঘার ঝাউবনের সারি দেখার মধ্যে যে আমেজ আছে, তা কিন্তু বাঙালির মননে এবং অবচেতনে বংশানুক্রমে বেঁচে আছে। আমাদের, কিংবা আগের প্রজন্মের এবং তারও আগে থেকেই ভ্রমণের প্রথম হাতেখড়ি শুরু হয়েছে দীঘার হাত ধরেই।
মনে করুন সেই ছোটবেলার কথা, হই হই করে গোটা পরিবার হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, দীঘার ট্রেন ঢোকার অধীর আগ্রহে। আপনার হাতে হয়তো ফেলুদার বই, গোয়েন্দাগিরি গল্পগুলো পরে মেদিনীপুরের আঁকা বাঁকা রাস্তা ঘাট আর ঝাউ গাছের জঙ্গল আপনাকে কাছে ডাকছে। ট্রেনের ছাড়ার কিছু সময় পরেই হয়তো মা কাকীমার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসছে থালা বাটি, যার ভেতরে গরম গরম লুচি আর আলুরদম। ট্রেনের দুলুনিতে আধো ঘুম চোখে বাইরে তাকিয়ে দেখছেন সবুজের সমারোহ। সত্যি, পৃথিবীটা আরও সবুজ ছিল তখন, তাই না? দেখুন ভিডিও
বাঙালির প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ বোধহয় লুকিয়ে আছে দীঘার সমুদ্রতটে। সে বিয়ের পরে নবদম্পতির হানিমুনে একে অপরের ভালবাসায় জড়িয়ে পড়া থেকে হোক বা ভেতো বাঙালির মহাসমুদ্র দর্শনের পর নিজেকে মহারাজ মনে হওয়ার অনুভূতি থেকেই হোক, দীঘা মানেই ছিল কিন্তু একটা রাজকীয় ব্যাপার। সমুদ্রতটের পাড়ে বসে, দিগন্তে সূর্যের ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ভরে ওঠে নানা রঙের কারসাজিতে, আবার ভোরবেলা সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যেত সমুদ্র থেকে নৌকা বোঝাই মাছ নিয়ে ফিরে আসছে মাঝি ভাইরা। বিকেলবেলাতে হয়তো বিচের ধারে কোনও ছোট্ট দোকান থেকে কিনে খেতেন নানা রকম মাছভাজা, কাঁকড়া বা চিংড়ি মাছ।
সকলে মিলে দীঘার অগভীর সমুদ্রের জলে নেমে সারা সকাল দুপুর কাটিয়ে, চান করে, হই হুল্লোড় করে উঠে আসার মধ্যে ছিল শৈশবের আনন্দের ছোঁয়া। স্মার্টফোন জমানার আগে সি বিচে তখন ছবি তুলতে সহায় হতে হতো হটশর্ট ক্যামেরার।
সেলফি তোলার হিড়িকে হারিয়ে যাওয়ার আগে দীঘার বালুকাবেলায় ঘোড়ায় চড়া ছবি হয়তো এখনও আপনার বাড়িতে সাজানো। রাস্তার ধারের দোকান থেকে কিনে আনা শামুকের ঘর সাজানোর জিনিস আজও স্মৃতিবিজড়িত হয়ে আছে শোকেসে। হয়তো দীঘার বিচে কোনও এক বিকেলবেলা যখন শেষ বিকেলের আলোয় আর সমুদ্রের প্রাণখোলা হাওয়ায় সবাই মাতোয়ারা তখন আপনার মনে ভিড় করে এসেছে ছুটি শেষের মেলাঙ্কলি সুর।
আসলে ৭০ বা ৮০র দশকে বা ৯০ দশকের অধিকাংশ সময় জুড়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির সাধ আর সাধ্যের মেলবন্ধন ঘটেছিল এই জায়গায়র মাধ্যমে। তাই এই জায়গা হয়ে উঠেছিল এত জনপ্রিয় আর বার বার ছুটি কাটানোর ফলে হয়ে উঠেছিল যেন আমাদেরই নিজস্ব আনন্দ উদ্যান। তাই দীঘার কিন্তু তার আদ্যোপান্ত বাঙালিয়ানায় কোনও ভাটা পড়েনি। দীঘার উত্তাল সমুদ্রে বাঙালি খুঁজে পেয়েছে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ৷ ৷ তাই আমাদের পুরনো ফোটো অ্যালবামগুলো বের করলে দেখতে পাই কীভাবে আমাদের শৈশব জুড়ে ছিল দীঘা।
একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তির যুগে হয়তো গোটা পৃথিবী আমাদের হাতের মুঠোয়। আন্দামান নিকোবর, মালদ্বীপের সমুদ্র বা সুইজারল্যান্ডের পাহাড়, দুই-ই এখন সমানভাবে বাঙালিদের হাতের মুঠোয়। তখন কেমন হয় আবার একবার দীঘার সৈকতে ফিরে গেলে?
যুগের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজ আমাদের চির পরিচিত দীঘা হয়ে উঠছে বিশ্বমানের গন্তব্যস্থল। সাস্টেনেবল ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটনের কথা মাথায় রেখে, সরকারের প্রচেষ্টায় এই জায়গা হয়ে উঠছে নতুন যুগের উপযোগী। দীঘার আশেপাশের বিভিন্ন স্পট, যেমন না মন্দারমনি, তালসারি, উদয়পুর বা শংকরপুর বিচেও আজকাল নতুন যুগের বাঙালিদের আনাগোনা।
নস্টালজিয়া আর ভালোবাসার দীঘা তাই আজ আমাদের প্রজন্মকে নতুন করে ডাক দিচ্ছে, নতুন স্মৃতি গড়ে তোলার আহ্বানে আজ আমরা আবার ফিরে যাচ্ছি শৈশবের পথে।