Chaitanya Mahaprabhu : ডেবরার উপর দিয়েই দক্ষিণ ভারতে গিয়েছিলেন মহাপ্রভু চৈতন্যদেব

0
1555

দেশের সময়: সময়টা পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগ। তখন পশ্চিম মেদিনীপুরের সব রাস্তা বুড়ামালা, শ্যামচক হয়ে নারায়ণগড়ের কাছে জগন্নাথ রাস্তার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই পথ দিয়েই দক্ষিণ ভারতে গিয়েছিলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য।

অবশ্য ঐতিহাসিক দিক থেকে ডেবরার পরিচিতি আরও প্রাচীন। ইতিহাস বলছে, পুরাতন নকশা অনুযায়ী সাহাপুর পরগনা ও বালিচক কেদারকুণ্ড পরগনার অধীনে ছিল ডেবরা। এই দুই পরগনার সীমানা ভাগ করেছে মেদিনীপুর খাল। উত্তর ভারত থেকে বাংলায় এসে জায়গীরদার স্থাপন করেছিলেন একাধিক রাজা। তাঁদেরই একজন যুগলকিশোর রায়। তিনি সাহাপুর পরগনা সংলগ্ন গড়কিল্লায় এসে রাজধানী স্থাপন করেন।

কথিত আছে, ধর্মপরায়ণ রাজা যুগলকিশোর বিশ্বনাথ দর্শনের জন্য কাশীযাত্রা করেন। পরে তিনি বিশ্বনাথের স্বপ্নাদেশ পান। রাজাকে কেদারেশ্বর শিব প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন মহাদেব। সেই নির্দেশ পালন করেন যুগলকিশোর। শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মন্দিরের পাশে জলাশয়ের ধারে গড়ে তোলেন কুণ্ড। সেই কুণ্ডেরই নাম হয় কেদারকুণ্ড, যা পরে হয় কেদারকুণ্ড পরগনা। অবশ্য এই কেদারকুণ্ডকে অনেকে চপলেশ্বরের মন্দির বলেন। এনিয়ে বিতর্ক আছে।

কথিত আছে, ১২৯৭ সালে গুজরাতে আলাউদ্দিন খলজির আক্রমণে রাজত্ব হারিয়ে সোলাঙ্কি রাজা দেবনাথ ওড়িশার জগন্নাথ মন্দিরে আশ্রয় নেন। তখন তিনিও স্বপ্নাদেশ পান। রাজাকে মেদিনীপুরের কেদারকুণ্ড পরগনার পশ্চিমী চুয়াড়দের অত্যাচার থেকে সামন্ত রাজাদের রক্ষা করার আদেশ দেন মহাদেব। সেই মতো রাজা চলে আসেন অধুনা কেদারকুণ্ডে। পরবর্তীতে রাজা একটি বিশাল জলাশয় খুঁড়ে শিবলিঙ্গ পান। সেই জলাশয়ের ধারে উঁচু জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেন শিবলিঙ্গটি। সেখানেই ১২৯৯ সালে গড়ে ওঠে মন্দির। যা চপলেশ্বর মন্দির নামে পরিচিত। জনশ্রুতি, এরপরই রাজা দেবনাথ ‘রায়’ উপাধি পান। সেই থেকে জায়গাটির নাম হয় দেবরায়। পরবর্তীতে লোকের মুখে মুখে দাঁড়ায় ডেবরা।

আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক বাণেশ্বর চক্রবর্তী লিখছেন, ব্রিটিশ আমলে ডেবরায় ইংরেজদের নীলকুঠি ছিল। শুধু তাই নয়, ডেবরা ও তার আশপাশের অঞ্চলে রেশম চাষ হত। স্বাধীনতার পর ১৯৫০ সালে ১৩ একর জায়গা নিয়ে ডেবরার সরকারি ব্যবস্থাপনায় তুঁত চাষ শুরু হয়। তাছাড়া প্রাচীন বাংলার নৌ বাণিজ্যের মূল স্থপতি যে অষ্ট্রিক গোষ্ঠী, তাদের অস্তিত্ব তমলুকে পাওয়া না গেলেও ডেবরা অঞ্চলে তাদের খোঁজ মিলেছে। অনেকে অবশ্য মনে করেন, স্থানীয় জমিদাররা তাঁদের চাষের জন্য মজুরের প্রয়োজনে পশ্চিমের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অষ্ট্রিক জাতির মানুষজনকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন।

জনৈক বীরসিংহ রাজা ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে ভঞ্জভূম দণ্ডপাটের রাজা হন। তিনি ছিলেন বর্ধমান প্রদেশের দামোদর নদ তীরের এক রাজার ভাই। পরবর্তীতে তিনি বর্তমান ডেবরা ও পিংলা থানার অন্তর্গত কেদারকুণ্ড গ্রামে বসবাস করতে শুরু করেন। কথিত আছে, ওই জায়গাটি দখল করতে গিয়ে বীরসিংহ এলাকার সাতশো বাগদিকে হত্যা করে তাদের ধড় ও মুণ্ড দু’টি স্তম্ভের নীচে পুঁতে দেন। সেই স্তম্ভটির নাম মুণ্ডুমারট ও গর্দানমারট নামে আরও পরিচিত। এগুলি পিংলা থানার অন্তর্গত। অন্যদিকে বীরসিংহের রাজত্ব কেদারকুণ্ড পরগনা, যা এখন ডেবরা থানার অধীনে। কথিত আছে, বীরসিংহ জাতিতে ছিলেন শুকলি। এরা মূলত সোলাঙ্কি রাজপুত। মুসলমানদের অত্যাচারের ভয়ে রাজপুতানা থেকে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নেন। পরে বীরসিংহের ভাই বর্ধমানের চাকলায় রাজত্ব করেন। আর বীরসিংহ থাকেন এখানে। বীরসিংহ এখানে যে গড় নির্মাণ করেন, সেই জায়গাটি নিজের নামানুসারে বীরসিংহপুর নামে প্রতিষ্ঠা দেন। যা আজও বর্তমান। এই বীরসিংহের প্রধান কীর্তি কেদারকুণ্ডতে চপলেশ্বর শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা। যা আজও কেদার ভুড়ভুড়ি নামে অখ্যাত। আসলে চপলেশ্বর শিব মন্দিরের পাশে যে পুষ্করিনি আছে, তাতে সবসময় ভুড়ভুড় শব্দে বুজফুড়ি উঠতে থাকায় জায়গাটির এমন নাম হয়েছে। বীরসিংহের শেষ বংশধর সুরন সিংকে তাঁর আত্মীয় লক্ষ্মণ সিং ও ভীষ্ম মহাপাত্র নামে দুই ব্যক্তি হত্যা করে তাঁর রাজ্য গ্রাস করে। সুরন সিংয়ের মৃত্যুর পর তাঁর দুই হত্যাকারী গোটা রাজ্যটিকে দু’টি ভাগে ভাগ করে লক্ষ্মণ সিং কর্ণগড় রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভীষ্ম মহাপাত্র প্রতিষ্ঠা করেন বলরামপুর রাজ্য।

ডেবরা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল একসময়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলা এবং ওড়িশায় যাওয়ার সংযোগস্থল ছিল ডেবরা। এই ব্লকের ভবানীপুর, মাড়োতলার ওপর দিয়ে ডেবরা পর্যন্ত যে রাস্তাটি রয়েছে, সেটি আগে নন্দকাপশা জাঙ্গাল নামে পরিচিত ছিল। সেসময় জেলার সব রাস্তা এই নন্দকাপশা জাঙ্গালের সঙ্গে মিশত। এখন এটিই ডেবরা থেকে বুড়ামালা পর্যন্ত বিস্তৃত, জাতীয় সড়কে গিয়ে মিশেছে।

পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে এই রাস্তা দিয়েই দক্ষিণ ভারতে গিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য। তবে তারও আগে পাঠান রাজত্বকালে এই জগন্নাথ রাস্তা ও নন্দকাপসা রাস্তার মাঝামাঝি অংশে আলি শাহ নামে এক ব্যক্তি জায়গিরদারি নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এই সেই এলাকাটি ডেবরার আলিশাহগড় ও এর পূর্ব অংশ বাহিরগড় নামে পরিচিত। আলি শাহ সেসময় নিজের গুরু সাহাবুদ্দিনের নামানুসারে সাহাপুর পরগনা তৈরি করেছিলেন।

কালের নিয়মে আধুনিকতার মোড়কে সেজেছে ডেবরা। হাওড়া-খড়্গপুর রেল শাখায় বালিচক স্টেশন ঘিরে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ডেবরার বসতি। সেই সঙ্গে সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্পে ছয় লেনের রাস্তা। মুম্বই-কলকাতা ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের ডেবরা থেকে সবং সড়কের মধ্যবর্তী অংশে বালিচক অবস্থিত হওয়ায় রয়েছে উন্নত বাস যোগাযোগ। ফলে পিংলা, সবং, নারায়ণগড়, খড়্গপুর গ্রামীণের করিডর বলতে বোঝায় বালিচক। ডেবরা ব্লকের অধিকাংশ অফিস কাছাড়ি বালিচকেই। ফলে কর্মসূত্রে সেখানে মানুষের বাস বাড়ছে। হু হু করে বাড়ছে জমির দাম। কিন্তু বসতি বাড়লেও নাগরিক পরিষেবা নিয়ে রয়ে গিয়েছে খামতি।

Previous articleSri Sri Matri Mandir Joyrambati :শতবর্ষে মাতৃমন্দির, জয়রাম বাটিতে পূর্ণ্যার্থীদের ঢল
Next articleYoga: যোগাসনে রাজ্য চ্যাম্পিয়ন বনগাঁর রানি : দেখুন ভিডিও

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here