তোমাকে বেসেছি ভালো… মলয় গোস্বামী

0
786
মলয় গোস্বামী:


” রন্ধনশিল্প ও কবিতাশিল্প এ দুইয়ের সঙ্গে যে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে , অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে এটা বোঝানোই আমার গুরুদায়িত্ব ৷ রান্না যে জিনিসকে করা হত বা সরাসরি আগুনের সঙ্গে যুক্ত থাকত, প্রথম প্রথম এই ছিল রীতি নিয়ম ৷ যেমন কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকত কবিতা ৷ অারও সহজ ভাষায় এই একই কথা লিখলে — বেগুন মুরগি ইত্যাদি আগুনের মধ্যে ঢুকিয়ে পোড়ানো হত প্রথম প্রথম ৷ অর্থাৎ আগুনের সঙ্গে যুক্ত থাকত বেগুন মুরগী ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য ৷ তেমনি তখন কবিতাও কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকত । কাজ করার সময়ই কবিতা অাপনিই মুখ দিয়ে না বেরিয়ে উপায় ছিল না । মুখ দিয়ে কবিতা রচনা না করে কাজ করাই যেতনা ৷ অর্থাৎ মুখ দিয়ে কবিতা রচনা না করে গাছের গুড়ি টানাই যেত না ৷ এখনও যায়না, কোনদিনযাবে না । অর্থাৎ এমন এমন অবস্থা হয় যে কবিতা রচনা করতেই হয় , যেমন বর্তমান যুগে এমন এমন অবস্থা হয়, যখন ভাত রান্না করতেই হয় । না হলে কবিতা রচনা করতেই হয় ৷

বিনোদিনী কুঠিরে বিনয় মজুমদার-পার্থ সারথি নন্দী৷

” ( `রন্ধন এবং কবিতা ‘ নির্বাচিত প্রবন্ধ … বিনয় মজুমদার ) কবিতা সম্পর্কে ঋষি কবি বিনয় মজুমদার এইরকম বলছেন  । পড়তে গিয়ে আশ্চর্য হতে হয় ৷ঘোর লাগে ৷ মনে হয় এক নিবিড় ঘাসের মধ্যে বসে, চার দিকে গাছপালা, বাংলার সরল গ্রামীণ সৌন্দর্য থৈ থৈ করছে … একজন প্রাজ্ঞ অন্য জগতের সৌন্দর্যে ভরপুর … খুব সহজ সরল করে কবিতার   জন্মরহস্য ফিসফিস করে বোঝাচ্ছেন ৷ ঠিক এইভাবেই বিনয় মজুমদার কবিতার রহস্য নিয়ে থেকেছেন আবার অন্যত্র কবিতা সম্পর্কে লিখছেন ” … আনন্দদায়ক বলেই কবিতা সারাজীবন হুবহু মনে থাকে ৷

একটি ভালো কবিতা পড়লে মনে আনন্দ হয় ৷ কবিতাটি পড়ার পরও অনেকক্ষণ অন্য কাজে মনোনিবেশ করা যায় না ৷ কেবলি ক বিতাটির কথা মনের মধ্যে ঘোরে ৷ এ অবস্থায় এই কবিতা ভিন্ন অন্য কোনো বিষয় আর মনে আসেনা ৷ কেবলই কবিতাটির কথা মনের মধ্যে ঘোরে — অর্থাৎ পাঠকের মন ভাবে বিভোর হয়ে থাকে ৷ কবিতা পড়ার পর কতক্ষণ মন ভাবে বিভোর হয়ে থাকে তার ওপরে নির্ভর করছে কবিতাটি কেমন । একটি কবিতা পড়ে একজন পাঠকের মন পাঁচ মিনিট ভাবে বিভোর হয়ে থাকল, আর একটি কবিতা পড়ে এই পাঠকেরি মন দশ মিনিট ভাবে বিভোর হয়ে থাকল । তাহলে প্রথম কবিতাটি অপেক্ষা দ্বিতীয় কবিতাটি ভালো । শুধু এই উপায়ে কবিতা কত ভালো তা বোঝা যায় । ”

( কবিতা ও আনন্দ ) পরম পান্ডিত্য এবং সারল্যের মিশেলে উদ্ভাসিত এই কবিকে আমি ভালবেসে ফেলেছিলাম সেই প্রথম যৌবনেই । শুধু মনে করতাম করে তাঁর সঙ্গে যে দেখা হবে ! কবে ঠাকুরনগরে যাব তাঁর সামনে ! তিনি লেখেন —- অমাবস্যা পূর্ণিমায় সব / মানুষের বাত বাড়ে ৷ আমারি তো বাড়ে / মন্দিরের দেবতা গো , কথাটা কি সত্যি নাকি বলো ৷ / মন্দিরের দেবতার জবাবের জন্য আমি অপেক্ষায় আছি ৷ / মন্দিরের দেবতা তো জবাব দিল না ৷ ”   এই সরলতা বিভূতিভূষণের মধ্যে পেয়েছি আমরা ।   যে কবির সঙ্গে দেখা করতে মন উতলা হয়ে উঠছিল তখন তিনি লিখেছেন, ” রসাত্মক বাক্য লেখা কবে যে আয়ত্ব হবে , ভাবি কবোষ্ণ প্রভাতবেলা উজ্জ্বল শব্দের দিকে চেয়ে অনুশোচনায় ভরে হৃদয় …” ৷ 

আমার বারবার মনে হয় সমস্ত জগৎযন্ত্রণাকেই যেন তিনি নারীপুরুষের বিচ্ছেদছবির মধ্যে দিয়ে জানাতে চেয়েছেন । তাঁর একটা কবিতা — ” বৃক্ষ ও প্রাণীরা মিলে বায়ুমন্ডলকে সুস্থ, স্বাস্থ্যকর রাখে ৷ / এই সত্য জানি, তবু হে সমুদ্র , এ অরণ্যে কান পেতে শোনো / ঝিঁঝিঁ পোকাদের রব — যদিও এ্খানে মন সকল সময় / এ বিষয়ে সচেতন থাকেনা, তবুও এই কান্না চিরদিন / এইভাবে রয়ে যায় . তরু মর্মরের মধ্যে অথবা আড়ালে ৷ ”  

ঠাকুরনগর প্লাটফর্মে বিনয় মজুমদার৷

১৯৭৯ সাল । আমি গোবরডাঙা কলেজে বি.এড পড়ছি ৷ সেই সময় একদিন ক্লাস শেষের পরে , বাড়ি ফেরার সময় গোবরডাঙা স্টেশনের ১নং প্ল্যাটফর্মে ঘোরাঘুরি করছি সহপাঠীদের সঙ্গে ৷ ট্রেন আসার দেরি । ২ নং-এ ট্রেন এলে বনগাঁর দিকে যাব ৷ সেই সময় দেখি ১নং প্ল্যাটফর্মের ছোট্ট বুক স্টলটির সামনে দাঁড়িয়ে বিনয় মজুমদার । হাতে একটা ছাতা । আমি কাছে গিযে ‘ তাঁকে দেখলাম । প্রণাম করলাম ৷ তিনি অবাক হয়ে আমাকে দেখতে লাগলেন ৷আমি রোমাঞ্চিত । তখন যেন মনে হচেছ ___ ” তুমি এসে ছিন্ন ছিন্ন চিঠির মতন তুলে দিয়ে কৌতূহলে এক ক’রে একবার পড়ে চলে যাও / যেন কোনো নিরুদ্দেশে ইটের মতন ফেলে রেখে ৷ ” 

এরপর অনেক গল্প ৷ সে অন্য কোথাও বলব ৷ সেই প্রথম ঋষি দর্শন । তারপর একবার দুবার বারবার । সে সব যেন স্বপ্নমাখা ঘটনাবলী । আজ এখানে এক পরম বৈদগ্ধ্যের ভেতরে সারাজীবন বাস করা একজন অমিতসরল কবির লেখার সঙ্গে কিছু সময় কাটানো যাক ।        ” কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে ।কৌটোর মাংসর মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভাউদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ, দিক চক্রবাল ৷ সভয়ে ভেবেছিলাম সম্মিলিত চায়ের ভাবনা বায়ুসেবনেব কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু ৷ ” 
” হে আলেখ্য, অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে ৷এই যে অমেয় জল — মেঘেমেঘে তনুভূত জল –এর কতটুকু আর ফসলের দেহে আসে বলো ? ফসলের ঋতুতেও অধিকাংশ শুষে নেয় মাটি । তবু কী আশ্চর্য দ্যাখো উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলেতার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সঙ্গীতময় মনে হয় । “

Previous article১০৮ টি নীল অপরাজিতা ফুলে পুজো হয় মিত্র বাড়ির দেবীদূর্গার
Next articleমহাষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি দিলেন নুসরত-সৃজিত-মিথিলা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here