দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ আশ্বিনের শারদ প্রাতে
বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জরি,
ধরনীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা,
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত
জ্যোতির্ময়ী জগৎমাতার আগমন বার্তা…
মহালয়ার সকালে এই গান শুনলেই মনে মনে পুজো এসে যায়। কিন্তু এবার মনে মনে এলেও সত্যি সত্যি আসবে না। অপেক্ষা করতে হবে এক মাসেরও বেশি সময়। জগৎমাতার আগমন বার্তা পেতে অনেকটাই অপেক্ষা করতে হবে।
পুজো এবার মহালয়া থেকে ৩৫ দিন পরে।পঞ্জিকা অনুযায়ী গত বুধবার সকাল ৯টা ৪৭ মিনিট পর্যন্ত ছিল পূর্ণিমা। অর্থাৎ, তার পর মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে পিতৃপক্ষ। চলবে এক পক্ষ অর্থাৎ ১৫ দিন। শেষ হবে ১৭ সেপ্টেম্বর মহালয়ার দিন। সেদিনই আবার বিশ্বকর্মা পুজো। সাধারণ ভাবে পিতৃপক্ষের অবসানে শুরু হয়ে যায় দেবীপক্ষ। কিন্তু এবার সেটা হচ্ছে না। অপেক্ষা করতে হবে গোটা আশ্বিন মাস। দেবীপক্ষ শুরু হবে ১৭ অক্টোবর। ৩০ আশ্বিন, শনিবার। আর দেবীর বোধন, ২২ অক্টোবর ষষ্ঠী তিথিতে।
পঞ্জিকা অনুসারে, অমাবস্যার পরেই শুরু হয়ে যায় দেবীপক্ষ। কিন্তু আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর অমাবস্যার পরে সেটা হবে না। কারণ, এবার আশ্বিন মল মাস। কোনও মাসে ৩০ দিনের মধ্যে দু’টি অমাবস্যা তিথি পড়লে তাকেই বলে মল মাস। সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, এমন মাসে কোনও শুভ কাজ করা যায় না। এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক পণ্ডত নবকুমার ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “মল মাস বিষয়টি নতুন কিছু নয়। এটা বছরের যে কোনও সময়েই পড়তে পারে।
তবে এই সময়টাতে কোনও শুভকাজ বা পুজো হয় না। ফলে যে বছর আশ্বিন মাসে এমন হয়, সে বছরই এই নিয়ম মানা হয়। সে কারণেই এবার দুর্গাপুজো মহালয়ার পর এতটা পিছিয়ে যাচ্ছে। পরের যে অমবস্যা তা ২৯ আশ্বিন, ১৬ অক্টোবর। সুতরাং, তার পরের দিন থেকে শুরু হবে দেবীপক্ষ।”
এবার আর তাই আশ্বিনের শারদপ্রাতে উমার আগমন হচ্ছে না। উৎসব আসতে আসতে কাশ ফুল হয়তো আর মাঠে থাকবে না। তবে এটা নতুন নয়। অতীতেও কার্তিক মাসে দুর্গাপুজো হয়েছে। পঞ্জিকা বলছে, ইদানীং কালের মধ্যে ১৯৮২ ও ২০০১ সালে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সেই বছরগুলিতেও আশ্বিন ছিল মল মাস।
তবে পঞ্জিকা যাই বলুক বিষয়টা বড়ই খাপছাড়া লাগবে। বাংলায় দুর্গাপুজো তো মহালয়ার দিন থেকেই শুরু হয়ে যায়। বাঙালির যেন তর সয় না। ইদানীং, অনেক পুজো মণ্ডপে তো মহালয়ার আগেই শুরু হয়ে যায় দেবী দর্শন। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে চলে উদ্বোধনের পালা। করোনা আবহে এই বছরে এমনিতেই উৎসব পালন কতটা করা যাবে তা নিয়ে চিন্তা রয়েছে। তবে অনেকে মনে করছেন, পঞ্জিকা কিছুটা সুবিধাই করে দিয়েছে। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে পুজো হওয়ায় করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে পারে। আর তাতে কিছুটা হলেও উৎসবে মেতে ওঠা যাবে।
দেবীপক্ষ দেরিতে হলেও গত বুধবার থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়েছে পিতৃপক্ষ পালন। সনাতন বিশ্বাসে এই সময়টাকে শ্রাদ্ধপক্ষও বলা হয়। কারণ, এই সময়ে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা হয়। ফি বছর বহু মানুষ এই সময়ে গয়ায় যান পিণ্ড দান করতে। হিন্দু ধর্মে এমন বিশ্বাস রয়েছে যে এই সময়ে গয়ায় শ্রাদ্ধ করলে তা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়। গয়ায় সমগ্র পিতৃপক্ষ জুড়ে মেলা চলে।
কিন্তু এবার করোনা আবহে সেটা করা যাচ্ছে না। কিন্তু ঘরে বসেও তর্পণে কোনও বাধা নেই বলেই জানিয়েছেন বিশিষ্ট পণ্ডিতেরা। তাঁদের কথায় , “জলদানের মাধ্যেমে পিতৃলোকের তৃপ্তিসাধনই হল তর্পণ বিধি। পুত্র কর্তৃক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সনাতন ধর্মে অবশ্য করণীয় একটি অনুষ্ঠান। যাঁরা নির্দিষ্ট দিনে শ্রাদ্ধ করতে ভুলে যান, তাঁরা এই সময়ে শ্রাদ্ধ করতে পারেন।”
গোটা পক্ষ কাল জুড়ে তর্পণ করা গেলেও এর জন্য সেরা দিন বলা হয় অমবস্যা তিথিকে। অর্থাৎ, মহালয়ার দিনকে। পণ্ডিত বিষ্ণু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সনাতন বিশ্বাস মতে, এই সময়ে প্রেতলোক থেকে পিতৃপুরুষের আত্মারা ফিরে আসেন মর্ত্যলোকে। আর তাতেই তৈরি হয় এক মহা আলয়। প্রয়াত পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার দিনটিই তাই মহালয়া। তিল-জল দিয়ে তর্পণ করে তাঁদের পরিতৃপ্ত করা হয়।
এই তর্পণ যেমন প্রয়াত বাবা-মা বা পূর্বপুরুষের জন্য, তেমনই সমগ্র জীবজগতের জন্যও।” তিনি জানান, এই সময়ে শুধু নিজের নয়, পরিচিত, অপরিচিত সকলের পিতৃপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা যায়। এমনকী মৃত পশুপাখিদের জন্যও করা যায় তর্পণ।