মাচায় বসা গল্পবাজ…

0
840
অশোক মজুমদার

এই সামান্য লেখাটা কিছু ‘গল্পবাজ’দের নিয়ে। গল্পবাজ বলতে পাড়ার রক, চায়ের দোকান কিংবা গ্রামের বটতলা বা চণ্ডীমণ্ডপের ধারে আড্ডা মারা কিছু নিরীহ এবং পরোপকারী মানুষকে ভেবে বসবেন না। এরা হলেন রাজনৈতিক গল্পবাজ। গল্পের গরুকে শুধু গাছে তোলা নয়, ক্ষতিকর মিথ্যা গল্প ফেঁদে মানুষের সর্বনাশ করতে এদের জুড়ি নেই। এদের রঙ্গ শুধু এই ভঙ্গ বঙ্গেই দেখা যায়। যে কোন বিষয় নিয়ে গল্প ফাঁদা এই অকর্মা মানুষগুলি এখন গল্প ফেঁদেছেন করোনা নিয়ে। রক আর চণ্ডীমণ্ডপের বদলে এরা গল্প বলেন প্রতি সন্ধ্যায় টিভির চ্যানেল, সকালে খবরের কাগজ আর দিনরাতের যে কোন সময় সোশ্যাল মিডিয়ায়। কেউ শুনুন বা না শুনুন, বুঝুন বা না বুঝুন মহা উৎসাহে হাত-পা নেড়ে এবং চোখমুখের বিচিত্র ভঙ্গী করে গল্প বলে যাওয়াটাই এদের একমাত্র কাজ।

গল্পের বিষয় একটাই, তা হল, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে কোন কাজেরই নিন্দা বা কুৎসা। করোনা থেকে আমফান সবকিছুকেই শেষমেশ কুৎসাতে পরিণত করার ব্যাপারে এদের এক আশ্চর্য দক্ষতা রয়েছে! চার দশক ধরে মানুষের মধ্যে কাজ করে যিনি ক্ষমতায় এসেছেন তার এতে কিছু যায় আসে না। আপন মনেই কাজ করে চলেছেন তিনি, মানুষও এদের গল্প শুনতে নারাজ তবুও এরা হাল ছাড়তে রাজি নন। মার্চের ৮-১০ তারিখ থেকেই নবান্নে করোনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১১ই মার্চ তো হু করোনাকে অতিমারি ঘোষণা করলো। ১৩ই মার্চ মুখ্যমন্ত্রী করোনা নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠক ডাকলেন, গোটা রাজ্য জুড়ে শুরু হয়ে গেল প্রশাসনিক তৎপরতা। একের পর এক জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে চললেন মুখ্যমন্ত্রী, গল্পবাজদের কিন্তু এসব কিছু চোখে পড়লো না। তারা বলে চললেন, মুখ্যমন্ত্রী কিছুই করছেন না, প্রশাসন নিষ্ক্রিয়!

বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেস নামক তিন সক্রিয় গল্পবাজ খোঁজই রাখলেন না লকডাউন ঘোষণার আগেই রাজ্যের শাসকদলের সব এমপিকে দিল্লি থেকে ফিরিয়ে এনে নিজের এলাকার করোনা পরিস্থিতির দেখার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপির এমপিদের অনেকেই এখনও অবশ্য দিল্লিতে। শুধু নির্দেশ আর বৈঠকই নয়, এই তৎপরতার চাক্ষুষ প্রমাণও রয়েছে। রাজ্যের একটা মাত্র টেস্ট ল্যাব থেকে ৪২টা টেস্ট ল্যাবের অনুমোদন করিয়েছেন তিনি। রাজ্যের কোভিড বেডের সংখ্যা ছিল ৮,৭০০ এখন তা দাঁড়িয়েছে ১০,২০০তে। হাসপাতাল ছিল ৬৯টি এখন কোভিডের মোকাবিলা করছে আরও ১১টি হাসপাতাল। না হলে রাজ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলা করোনা কেস সামাল দেওয়া যেত না। এসব কোন কিছুই তিন গল্পবাজদের গল্পে ধরা পড়ে না।

আমি পণ্ডিত নই, এই সামান্য লেখায় বিরাট কিছু পরিসংখ্যান থাকে না। কিন্তু যখন কথা উঠছে তখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান আমাকে দিতেই হবে। নাহলে এদের নিরস্ত করা যাবে না। দেশে প্রথম করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে কেরলে, গত ৩০শে জানুয়ারি। ২৭শে মে পর্যন্ত কেরালায় মোট টেস্ট হয়েছে প্রায় ৫৯ হাজার। এদিকে বাংলায় প্রথম করোনা পজিটিভ কেস ধরা পড়ে ১৭ই মার্চ। গত ১৮ই মার্চ থেকে ৫ই জুন পর্যন্ত এ রাজ্যে টেস্ট হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৫১ হাজার। গল্পবাজরা বলে চলেছেন, রাজ্যে শিল্প নেই, কাজ নেই তাই পরিযায়ী শ্রমিকও নেই। কিন্তু তাদের গল্পের ফাঁকেই লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর থেকে রাজ্যে চালু হয়ে গেছে ৭১১টি কমিউনিটি কিচেন। মুখ্যমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় চলা এই উদ্যোগে প্রায় ২ লাখ ১১ হাজার মানুষের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভিন রাজ্যের প্রায় দেড় কোটি মানুষ যারা এ রাজ্যে আছেন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে তাদেরও।

গল্পবাজরা কুৎসার বাইরে কিছু ভাবতে চান না বলেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানবিক মুখ তাদের চোখে পড়ে না। কয়েকদিন আগে খবরের কাগজে দেখলাম, হুগলীর পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরার জন্য ব্যান্ডেল ষ্টেশন থেকে ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনাটা কী ঘটলো? ১৫০০র বেশি টিকিট করা হলেও ফিরলেন মাত্র ২১৩ জন। যারা ফিরেছেন তারাও ষ্টেশনে থাকা ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকদের বলে গেছেন, বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করে আবার ফিরে আসবো। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর মানবিক পরিষেবার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে।

করোনা ছাড়িয়ে আমফানের পৌঁছেও গল্পবাজদের আষাঢ়ে গল্প অব্যাহত। তারা বলছেন, আমফান মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী ব্যর্থ। কিন্তু ঘটনা হল, ভয়াবহ এই ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাষ পাওয়া মাত্র বাংলায় তৎপর হয়েছে প্রশাসন। প্রায় ৪ লাখ মানুষকে সুরক্ষিত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেই ঝড়ের প্রচন্ডতার তুলনায় মানুষের প্রাণহানি চোখে পড়ার মত কম হয়েছে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী অতিমারি, উন্নয়ন এবং দুর্যোগ মোকাবিলার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে রাজনীতি করেন না। তাই তিনি নিজের থেকেই প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন, ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ঘুরে পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা করার জন্য। ১০ লক্ষ কোটির ক্ষতির সাহায্যের যেখানে দরকার সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ভিক্ষে এসেছে মাত্র হাজার কোটি টাকা! পিএম কেয়ারসের টাকার অডিট হবে না। ফলে সেই টাকায় কী হবে কেউ জানেনা। এদিকে বাংলা ও ওড়িশার ঝড় পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য ফ্রান্স দেবে ১৭০০ কোটি টাকা। গল্পবাজরা কী বলবেন?

আমফান বিধ্বস্ত ৫ লাখ মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঝড়ের ৯-১০ দিনের মধ্যে পৌঁছে গেছে ২০ হাজার টাকা। বিপর্যয়ের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য এই সাহায্য পদ্ধতি দেশে এই প্রথম। প্রতিটি রাজ্য করোনার মোকাবিলায় সাহায্যের জন্য কেন্দ্রের কাছে দরবার করছে। কর্মচারীদের মাইনে কাটছাঁট করছে কিংবা কর বসাচ্ছে কিংবা বিদ্যুৎ, জল ইত্যাদিতে কর বসাচ্ছে। বাংলায় কিন্তু এ সমস্যা নেই, কর্মচারীরা বেতন, ভাতা ইত্যাদি ঠিক সময়ে ঠিকঠাক পাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় সরকার নতুন প্রজেক্ট বন্ধ করে দিয়েছেন, কেটেছেন কর্মীদের মাইনে ও ডিএ, সাংসদদের ভাতা কাটা হয়েছে। বাংলায় করোনা, আমফান এর মত জোড়া সঙ্কট সামলেও এসব কিছুই হয়নি। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও পর্যন্ত রাজ্যে কোন চালু প্রজেক্ট বন্ধ করেননি। গল্পবাজরা কী বলবেন?

গল্পবাজরা কিছু দেখতে পান না আর চোখ বন্ধ করে থাকেন যাদের মাচায় বসে এরা গল্প বলে চলেন সেই একশ্রেণির সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া। তাই কুৎসা আর ‘গল্প’ চলতেই থাকে। কিন্তু গল্পবাজরা বুঝতে পারছেন না এই মিথ্যা আর কুৎসার পাহাড়ে তারা নিজেরাই একদিন চাপা পড়ে যাবেন।

Previous articleসল্টলেকের বাড়ির দরজা ভেঙে সুরজিৎ কর পুরকায়স্থর প্রাক্তন স্ত্রী এবং শাশুড়ির মৃতদেহ উদ্ধার
Next articleজ্বর নিয়ে আইসোলেশনে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী,কাল হবে করোনা টেস্ট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here