বুলবুলে-বিধ্বস্ত মৌসুনি,ফিনিক্স পাখির মতো ফের জেগে ওঠছে

0
804

হৈমন্তী সেন,দেশের সময়: বুলবুলের ঝাপটায় ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীপগুলির মধ্যে অন্যতম নামখানার মৌসুনি। চিনাই নদী ও বঙ্গোপসাগর দিয়ে ঘেরা এই দ্বীপ। সাগরদ্বীপ লাগোয়া এই দ্বীপ ব্যাপক ক্ষতির মুখে। আয়লার পর সমুদ্রবাঁধ বেহাল হয়ে পড়ে। তারপর থেকে প্রতি কোটালে প্লাবিত হয় এখানকার নীচু এলাকা। ভাঙন এখানকার ভিটেমাটি সব গিলেছে। নদীর চরের বিবর্ণ গাছগুলির ওপর চোখ পড়লেই তা মালুম হয়। মরা গাছের সারি গোটা তট জুড়ে।

এবারও বুলবুল–‌এ ভেঙেছে গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, বাড়ির ছাউনি, পানের বরোজ। জমা জলে প্লাবিত হয়েছে ধানের জমি, পুকুর। অনেক বাড়ি এখনও জলবন্দি। বালিয়াড়া, সল্টঘেরি ঘুরলে সেই বিপর্যয়ের ছবি ধরা পড়ে। শনিবার রাতে বুলবুলের তাণ্ডবের পর থেকে কার্যত খণ্ডহরের চেহারা নিয়েছে দ্বীপটি। অনেক বাড়িতে এখনও চুলো জ্বলেনি। ঘরের মধ্যে জলকাদা মাখামাখি। সেই জলকাদার মধ্যে দিন কাটানো দায়।

এখনও সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে শিউরে উঠছিলেন এখানকার বধূরা।


বছর তিরিশের বৃদ্ধা মনোরমা বিবি বলেন, ‘‌ঝড় আসার খবর পাওয়ার পর বাড়ি ছাড়তে বলেছিল প্রশাসন। কিন্তু বাড়ি ছাড়িনি। সন্ধে থেকে ঝড়ের দাপট বাড়ছিল। রাত বাড়তে দাপট আরও বেড়ে গেল। ঘরের এক কোণ ৩ ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসেছিলাম। পাশেই রেখেছিলাম বাড়ির হাঁস, মুরগি ও ছাগলগুলোকে। কারণ ওদের ছেড়ে দিলে ঝড়ের দাপটে মরে যেত। ভোররাতে ঝড় থামলেও ঘুমোতে পারিনি। উপরওয়ালা বাঁচিয়ে দিয়েছে।’

‌ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মন্মথ মাইতি বলে ওঠেন, ‘‌ঝড় আমরা অনেক দেখেছি। নদীর ধারে বাস। কিন্তু এবার সব ঝড়কে ছাপিয়ে গিয়েছে। এমনকী আইলার সময় ঝড়ের এত দাপট ছিল না। ভাটার সময় ঝড় ওঠায় বাঁধের ক্ষতি হয়নি। এবারের ক্ষতি পোষাতে অনেক দিন লাগবে।’‌ এদিন বিকেলে প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গাঙ্গুলি আসেন, দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলেন।
মৌসুনি দ্বীপে হোম স্টে ট্যুরিজম বেশ জনপ্রিয়। বঙ্গোপসাগরের বালিয়াড়িতে ঝাউবনের ভেতর প্রায় ৪০টি প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। সেগুলি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। ঝাউগাছ ভেঙে তছনছ। জলমগ্ন এলাকাগুলি। সমস্ত বুকিং বাতিল করা হয়েছে। ১৫ দিনের আগে পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন। শীতের মুখে এই ধাক্কায় প্রচুর ক্ষতির আশঙ্কা। এক পর্যটন কেন্দ্রর মালিক মেঘনাথ বারুই বলেন, ‘‌প্রকৃতির রোষে সব তছনছ হয়ে গিয়েছে। প্রচুর পাখির বাসা ভেঙে গিয়েছে। গাছ পড়ে ভেঙে গিয়েছে হোমগুলি। সরকারি সাহায্য পেলে আবার ঘুরে দাঁড়ানো যাবে।’

বন কেটে বসত করার প্রথম দিন থেকেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার আশ্চর্য প্রযুক্তি কী এক মন্ত্রবলে যেন আয়ত্ত করে নেয় ওরা৷ বারবার আয়লা, বুলবুলের মত বিধ্বংসী ঝড় এদের একটু একটু করে গড়ে তোলা স্বপ্নকে মিলিয়ে দেয় মাটির সাথে৷ সেই ধ্বংসস্তূপ থেকেই ফিনিক্স পাখির মতো আবার জেগে ওঠেন মনোরমা,মন্মথরা। আবার জেগে ওঠে সুন্দরবন৷

সারাদিন ধরে ভেঙে যাওয়া বাড়ি, গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি দেখতে দেখতে গোটা দ্বীপ ঘুরে, বিষণ্ণ মনে ফিরে আসার সময় মৌসুনি বাজারে, শুনতে পাই, সুন্দরবন বিষয়ক একটি পত্রিকা বালিয়ারার একশোটি পরিবারের প্রত্যেকের হাতে তুলে দিয়েছে নতুন জামাকাপড়। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মৌসুনি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এনেছে শিক্ষাসামগ্রী। সন্ধ্যে নামার সময়ে দেখি চারটি বড় মেশিনভ্যানে বালিয়ারার দিকে যাচ্ছে এক হাজার সরকারি ত্রাণের ত্রিপল৷

ফের বুঝতে পারি, হাজার হতাশার মাঝে আজও বেঁচে আছে মানবিকতা… বারবার ধ্বংসের মাঝে টিকে থাকা সুন্দরবনের মানুষগুলোর মতোই ৷

Previous articleরাস উৎসবকে ঘিরে মেতে উঠেছেন বনগাঁর মতিগঞ্জ সাহাপাড়া
Next articleকার্তিক পূর্ণিমায় পরেশনাথকে নিয়ে মাতল কলকাতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here