পুজোর হইচই শেষ হতে কেটে গেল অক্টোবরের বাইশ তারিখ।তেইশের সকালে উঠে মনে হল পরশু দুপুরে ট্রেন অথচ গোছগাছ কিছুই হয়নি।যুদ্ধকালীন তৎপরতায় লিস্ট মিলিয়ে বাঁধাছাঁদা শুরু করা গেল।যত সহজে লেখা হল কাজটা ততটাই কঠিন।সূচ থেকে শ্যু লিস্টে সব কিছু ছিল ফলে মিলিয়ে তুলতেই গলদঘর্ম অবস্থা। সন্ধ্যের দিকে অবস্থা যখন অনেকটা আয়ত্ত্বাধীন তখন ফোনটা এল।ওপারে মান্তু,”কাকু খবর শুনেছ ? ” ওর গলা কেমন অসহায়।যথেষ্ট উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করি,” কি হয়েছে রে ? ” মান্তু বলে, “পরশু আমাদের যাওয়ার ট্রেন ক্যানসেল হয়েছে”। উত্তর শুনে থম হয়ে থাকি কিছুক্ষণ,তারপর বলি,” তাহলে উপায়? ” মান্তু বলে,”তুহিন কাকুর বাড়িতে সন্ধ্যায় গ্রুপের সবাই মিটিং এ বসছে তুমি একটু যাও প্লিজ”।
অতএব রইল ঝোলা ছুটল ভোলা তুহিনদার বাড়ি।সেখানে স্থির হল ট্যুর অপারেটর আপৎকালীন পরিস্থিতিতে যে সিদ্ধান্ত নেবেন আমরা তা মেনে নেব।জানা গেল হারুদা অন্য ট্রেনে তৎকাল টিকিট কাটার চেষ্টা করবেন,তবে প্রায় ষাট জনের টিকিট একসাথে হবে কীনা সেই সংশয় থেকে গেল।শেষ পর্যন্ত ট্যুর বাতিল হবে নাতো, এই উৎকন্ঠা নিয়ে রাত কাটল।
চব্বিশ তারিখ দুপুরে জানা গেল বারোজন বাদে বাকিদের টিকিট হয়েছে অমৃতসর মেলে।ট্রেন পঁচিশের সন্ধ্যা সাতটা পঁয়তাল্লিশে হাওড়া থেকে।সুতরাং দ্বিগুন উৎসাহে অসমাপ্ত গোছগাছ পর্ব শুরু হল।অবশ্য মনের মধ্যে আচমকা দলছুট হয়ে পড়া বারোজনের জন্য অদৃশ্য কাঁটার খচখচানি রয়ে গেল।বিকেলের দিকে খবর এল ওদের এয়ার টিকিটের ব্যবস্থা হয়েছে।ফলে সন্ধ্যার দিকে যাবতীয় উৎকন্ঠা ফুৎকারে উড়িয়ে মন ফুরফুরে হয়ে উঠল।
এতক্ষণ শিবের গান গাওয়া হল অথচ ধান ভাঙার কাজ শুরু করা গেল না।মানে কোথায় যাওয়া হচ্ছে,কীভাবেই বা যাওয়া সে কথা বলা হয়নি।তাহলে সে বৃত্তান্ত আগে বলে নিই।
এবার আমাদের যাত্রা উত্তরাখন্ডের কুমায়ুনের উদ্দেশ্যে।প্রাথমিক ভাবে আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা ছিল এই রকম—-পঁচিশ অক্টোবর দুপুরের কলকাতা-আগ্রা ক্যান্ট ট্রেন ধরে ছাব্বিশ ভোরে লক্ষ্ণৌ পৌঁছানো। সারাদিন লক্ষ্ণৌতে কাটানো এবং ঘোরা।ওই দিন রাত একটার লালকুঁয়া এক্সপ্রেস ধরে সাতাশের সকালে লালকুঁয়া স্টেশনে নেমে আলমোড়া পৌঁছানো।বিশ্রাম নিয়ে দুপুরে বিনসর ঘুরে আলমোড়ায় রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে মুন্সিয়ারির দিকে যাত্রা শুরু করা।কিন্তু সব পরিকল্পনা ঘেঁটে গেল কলকাতা-আগ্রা ট্রেনটি বাতিল হওয়ার জন্য।হাওড়া-অমৃতসর মেল লক্ষ্ণৌ পৌঁছাবে ছাব্বিশ তারিখ বিকেল তিনটেয় ফলে ট্রেনে ওঠার আগেই লক্ষ্ণৌ ঘোরার পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়।
হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়ল যথাসময়ে।অবশেষে যাওয়া হচ্ছে এটা ভেবেই সকলে বেশ হাশিখুশি। এপাড়া ওপাড়া(বিভিন্ন কোচ) বেড়িয়ে গল্প আড্ডা জমে উঠল।ছাব্বিশ সকাল থেকেই মন উচাটন কখন লক্ষ্ণৌ পৌঁছাবে ট্রেন ! এর মাঝেই হোয়াটস অ্যাপে ডাকুর(সৈকত) মেসেজ এল প্লেন যাত্রীরা নির্বিঘ্নে লক্ষ্ণৌ পৌঁছে, শহর ঘুরতে বেরিয়ে গেছে।এই খবরে সকলের স্বস্তির শ্বাস পড়ল।ট্রেন থামল পন্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশনে।কিছুক্ষণ থামবে এখানে। বাথরুম সাফাই,জল ভরা চলল।হাত পা ছড়িয়ে নেওয়ার জন্য স্টেশনে নেমেছিলাম।এক দেহাতি যুবক অনেকক্ষণ অবাক হয়ে চারদিক দেখছিল শেষমেশ সামনে আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করে ফেলল, “বাবুজী ইয়ে মুঘলসরাই স্টেশন হ্যায় না ? ” উত্তর দিই,” হাঁ সহি হ্যায়”।এবার সে আরও অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,”লেকিন ইহা কহি ভি মুঘলসরাইকা নাম লিখখা নেহি হ্যায়।কিঁউ ? “তাকে আমার সীমিত হিন্দি জ্ঞান দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি যে মুঘলসরাই-এর নাম পালটে দীনদয়াল উপাধ্যায় রাখা হয়েছে।সব শুনে সে তার সরলতা মাখা মুখ আবারও প্রশ্ন করে, ” লেকিন কিঁউ “? হাল ছেড়ে দিয়ে উত্তর দিই, ” কিঁউ কী,কিঁউ কা কোই জবাব নেহি হোতা”। “লেকিন… “,আর কিছু না শুনে ঝটপট ট্রেনে উঠে পড়ি।ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখি বিপন্ন বিস্ময় নিয়ে তার চোখ তখনও খুঁজে চলেছে মুঘলসরাই নামটি।
বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আমাদের লক্ষ্ণৌ স্টেশনে নামিয়ে অমৃতসর মেল গন্তব্যের দিকে চলে গেল।বিকেলের পড়ন্ত আলোয় স্টেশন ভবনের স্থাপত্য প্রাচীন নবাবমহলকে মনে করিয়ে দিল।হোটেলে চেক ইন করেই শহরে বেরিয়ে পড়া গেল অল্প সময়ে যেটুকু দেখে নেওয়া যায়।বড়া ইমামবাড়া সন্ধ্যে ছটা পর্যন্ত খোলা থাকে। সবে পাঁচটা বাজে অটো নিয়ে ইমামবাড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল।কিন্তু কিছুটা যেতেই অটো আটকে গেল যানজটে।গেল তো গেলই, একেবারে নড়নচড়ন নট।সবাই বেশ ঘেঁটে দেওয়ার প্রানান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।যে যেখানে পারে ঢুকে পড়ে স্টার্ট বন্ধ করে নির্বিকল্প সমাধিস্থ হয়ে পড়ছে।নবাবের আমল নেই বটে কিন্তু নবাবি আয়েশি চাল আছে,কারো কোনও ব্যস্ততা নেই,সকলেরই গয়ংগচ্ছ ভাব।বাঁদিকে সাজানোগোছানো পুলিশ সহায়তা কেন্দ্র তবে ভালো করে লক্ষ্য করলে নির্ঘাৎ “তোমার দেখা নাইরে” গানটা মনে পড়বে।এখানে ট্রাফিক পুলিশ কই? প্রশ্ন শুনে অটোচালক কিঞ্চিৎ অবাক হল মনে হয়।পাশের অটোর দুজন সওয়ারি নেমে চলে গেল। বোধহয় বিরক্ত হয়ে।একটু পর দেখি রাস্তার ওপারের দোকান থেকে পান চিবোতে চিবোতে এসে আবার অটোয় উঠে পড়ল।এইভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে অটো যখন ইমামবাড়ার সামনে এল তখন গেট বন্ধ হয়ে গেছে।আমদের পড়িমরি করে গেটের দিকে ছুটে আসা,তারপর কলকাত্তা থেকে আয়া হ্যায় শুনে দ্বাররক্ষীর হয়তো মায়া হল।গেট সামান্য ফাঁক করে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিল,” দের মত কর না।জলদি ওয়াপস আইয়ে।”
আলোয় ঝলমল করছে ইমামবাড়া।এই ইমামবাড়া ১৭৮৪ সালে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের সময় নবাব আসফউদ্দোলা প্রজাদের কাজের বিনিময়ে অর্থ ও আহারের ব্যবস্থা করে নির্মাণ করেন। পাশেই আসফি মসজিদ। বড়া ইমামবাড়ার প্রধান বৈশিষ্ট হল কোনও কড়ি-বরগা বা স্তম্ভের ব্যবহার ছাড়া নির্মাণ করা হয়েছে সুবিশাল (৫০ ফুট ) সেন্ট্রাল হল ও ছাদের অংশে অভিনব ভুলভুলাইয়া।যদিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য ভুলভুলাইয়া আমাদের দেখা হল না।এরপর যাওয়া হল লক্ষ্ণৌএর বিখ্যাত চিকন পোশাকের বাজারে।দেখাশোনা কেনাকাটা শেষে সিদ্ধান্ত হল যে, লক্ষ্ণৌ এসে বিরিয়ানি, কাবাব না খাওয়া অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।তাই বিস্তর ভিড় কাটিয়ে ‘তুন্ডে কাবাব’এর দোকানে ঢুকে অপরাধ স্খালন করা হল।যাহোক লক্ষ্ণৌ একেবারে বঞ্চিত না করে কিঞ্চিৎ যা দিল তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে ফেরা হল হোটেলের ঘরে।আপাতত ঘন্টা তিনেক বিশ্রাম।রাত একটায় লালকুঁয়া এক্সপ্রেস ধরতে হবে।
(ক্রমশ)