পিয়ালী মুখার্জী, কলকাতা: ২৬১ বছরের টালিগঞ্জ করুণাময়ী কালী মন্দিরের স্থাপনা হয় ১৭৬০ সালে বড়িশার সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের ২৭ তম পুরুষ নন্দ দুলাল রায় চৌধুরী কর্তৃক। এই কালী মন্দিরের বিশেষত্ব হলো এখানে কালী পুজোর দিন হয় কুমারী পুজো।
শোনা যায়, নন্দ দুলালের তিন পুত্র সন্তান ছিল কিন্তু তাঁর বাসনা ছিল একটি কন্যা সন্তানের। সেই মনোকামনা নিয়ে তিনি ইস্টদেবীর পুজো করেন। দেবীর কৃপায় তাঁর অভীষ্ট বাসনা পূর্ণ হয়। অসামান্য রূপ ও জ্ঞানের অধিকারিণী এক কন্যার জন্ম হয়। জন্মের পর সকলে বলল সে মেয়ে নাকি দৈবগুণ সম্পন্ন। নন্দ দুলাল মেয়ের নাম রাখলেন করুণা।
কিন্তু সেই মেয়ের মাত্র সাত বছর বয়সে হঠাৎ ই মৃত্যু হয়। প্রাণাধিক প্রিয় কন্যার মৃত্যুতে শোকে পিতা নন্দ দুলাল স্থির করলেন সংসার ছেড়ে তিনি তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন, কিন্তু সেই রাতেই কন্যা করুণা রূপে আসেন দেবী মহামায়া। বলেন যে পিতাকে ছেড়ে তিনি কোথাও যাননি। আদেশ দেন আগামীকাল ভোরবেলা আদি গঙ্গার ঘাটে যেতে, সেখানে এক বটবৃক্ষের তলায় একটি কষ্টি পাথর পাবে তা দিয়ে ইষ্ঠ দেবীর মূর্তি বানিয়ে সেখানেই যেন প্রতিষ্ঠা করেন তাঁকে। এর পরই চতুর্ভুজা দেবী দক্ষিনা কালী রূপে দেখা দিয়ে অদৃশ্য হন।
স্বপ্নাদেশ পেয়ে ঊষাকালে আদিগঙ্গায় বটবৃক্ষের নীচে এক খণ্ড কষ্টিপাথর পেয়ে তাতে খোদাই করেন দক্ষিনা কালীর মূর্তি যা ওই জায়গায়তেই মন্দিরে স্থাপন করে প্রতিষ্ঠা করেন। কন্যার নাম অনুসারে দেবীর নামকরণ হয় শ্রী শ্রী মা করুণাময়ী।
সেই থেকেই টালিগঞ্জ করুণাময়ী কালীবাড়িতে কালী পূজিত হন বাড়ির মেয়ে রূপেই। কালীপুজোর দিনই প্রথম পুজো করেন নন্দ দুলাল রায় চৌধুরী, আর যেহেতু নিজের মেয়ে রূপেই তিনি মা কালীর আরাধনা করে এসেছেন, সেই রীতি মেনেই এখানে কালী পুজোর দিন অনুষ্ঠিত হয় কুমারী পূজা। করুণাময়ীকে দেওয়া হয় ১১ রকম মাছের ভোগ। ঘরের মেয়ের মতোই তার সেবা এবং সে যা যা খেতে ভালোবাসে সেসব দিয়েই তার পুজো হয়।
নন্দ দুলাল দ্বাদশ শিব মন্দির সহ মায়ের মূল মন্দির হিসাবে একটি নবরত্ন মন্দির স্থাপন করেন। যদিও কালের নিয়মে রক্ষণাবেক্ষণ এর অভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পরে আটচালার মন্দির গড়ে ওঠে। সেটিও পরে কালের করাল গ্রাসে পরে। তখন সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের তৎকালীন আর এক পুরুষ অসিত রায় চৌধুরী মন্দিরের নতুন রূপ দেন। অবশেষে নব কলেবরে টালিগঞ্জের শ্রীশ্রীকরুণাময়ী কালী মাতার মন্দিরের শুভ উদ্বোধন হয় ১৯৮৫ সালের ১৭ই অক্টোবর।
সামাজিক কল্যাণ সাধনে প্রত্যয়ী মন্দিরের অছিপরিষদ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ, শ্রীশ্রীমা ও শ্রী বিবেকানন্দের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত। ২০০১ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিবছর কল্পতরু উৎসব পালন করা হয়। উপস্থিত থাকেন রামকৃষ্ণ মিশনের বহু সন্ন্যাসীবৃন্দ। “শিব জ্ঞানে জীব সেবা” ঠাকুরের এই মূল মন্ত্র কে বজায় রেখে শ্রী অশোক রায় চৌধুরীর উদ্যোগে নেওয়া সকল প্রকার সেবামূলক কাজ কে বাস্তবে রূপান্তরিত করে। মন্দিরের তথা সেবা মূলক কাজে দীক্ষিত মন্দিরের কর্মীরা মনে করেন শ্রী শ্রী ঠাকুরের জীবনাবসানের ১৩০ বছর পেরিয়েছে। এখনো বহু পথ চলা বাকি।
টালিগঞ্জের করুণাময়ী কালীবাড়িতে বৃহস্পতিবার সকালে কালীপূজোর দিন কুমারী পূজো অনুষ্ঠিত হলো। ছবিগুলি তুলেছেন -ধ্রুবহালদার।