সেই সব শরৎ : সেই সব দিন”
মলয় গোস্বামী:
জানলার পাশেই তক্তপোষ I আমি রাত্রে ঘুমিয়ে থাকতাম জানলার পাশটিতেই৷ ভাই শুতো আমার পাশে ৷ জানলাটা পুব দিকে। শরৎকাল আমার আগেই মনের মধ্যে যেন কেমন করে উঠত৷ ভোরের বাতাস যেন তখন একটু ক’রে পাল্টাচ্ছে৷ পরে বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি, ওই যে সেই – ‘পূব হাওয়াতে দেয় দোলা` পুবের জানালা দিয়ে ভোরের রোদ্দুর আসত। শরতের রোদ্দুর যেন সেনালি রঙের ৷ মিষ্টি- উষ্ণ৷ গা- হাত- পা স্নিগ্ধ হতো৷
তখন কার উঠোন হতো অনেক বড় ৷ এক পাশে ঘর বাড়ি৷ উঠোন চারদিকে গাছ পালার বেড়া৷ খুব ভোরে মা, ছোটমা, বড়মা-রা দিত গোবরের ছড়া৷ প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতেই নানা রকম ফুলের গাছের সঙ্গে থাকত অন্তত একটা করে শিউলি ফুলের গাছ৷ আমাদেরও একটা ছিল’ সেই গাছের তলা মা ও বোনেরা খুব ভাল করে গোবর দিয়ে প্রতিদিন লেপে দিত। কোনও ময়লাই থাকত না`৷ ভোরে উঠেই যখন দেখতাম সেইখানে শিউলি ফুলে ভর্তি হয়ে আছে, তখনই বুঝতাম – দুর্গা পুজোর আর দেরি নেই। গায়ে হিমের বাতাস লাগছে৷ আমার মনে হত আকাশ থেকে তারা খসে পড়েছে৷ বাইরে বের হলেই বাবা বলত, গলায় মাফলার জড়া’ ঠান্ডা লাগবে।
শরৎ কালের ভোর আমার জীবনে বেশ বড় জায়গা জিয়েই থেকে গেল৷ মনে পড়ে ” এসেছে শরৎ হিমের পরশ/ লেগেছে হাওয়ার পরে/ সকাল বেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা ধরে।”শিতের শিশির বিন্দু যেন আগে থেকেই শরতে এসে আবির্ভূত হয়৷
ছোট বেলায় ঘাসের ওপরে পড়া শিশির বিন্দুর কাছে নিজের মুখ নিয়ে গেছি আয়নার মতো দেখার জন্য। এমনই রুপ মুগ্ধ হতাম খন কি সেই শরৎ আছে? ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কাছে যে তা নেই ,সে কথা বুঝতে পারি৷ আমারই ছেলে মাঝরাত পর্যন্ত মোবাইলে থেকে,সকাল পার করে তবে ওঠে।ওদের কাছে শরৎ আর নেই। ভোগবাদের তছনছ আমাদেরকে প্রকৃতি থেকে দূরে নিয়ে ফেলেছে৷ এখন বন্ধ দরজার এয়ারকন্ডিশনের মধ্যে মুমিয়ে -থাকা কিশোর কিশোরীর পা- য়ে কী ভাবে সূর্যের সোনালি রঙের রোদ্দুর এসে পড়বে? পড়বে না৷ শরৎ -এর প্রকৃতির অসামান্য রুপের যে টুকু অবশিষ্ট আছে, তারও স্পর্শ বর্তমান শিশু -প্রজন্ম পেল না ডেবে খুব কষ্ট হয়৷
থাকগে এসব কথা ,তবু শরৎ যেহেতু টেনে আনে আমাদের কৈলাসবাসিনী দুর্গা মা-কে ,সঙ্গে আসে তাঁর ছেলে মেয়েরা, তাদের নিয়ে উৎসব চলে ক’দিন৷ বাঙালির প্রধান উৎসব । রঙিন রঙিন পোশোক পরিচ্ছদে ঝলমল করে চতুর্দিক৷ এরও এক আনন্দ আছে।
আমাদের কৈশোর উত্তীর্ণ সময়ে শরৎ কালের প্রেমও নিয়ে আসত৷ কিশোরীদের মুখে চোখে যেন শরতের রুপ ফুটে উঠত ৷ কতবার যে আমরা ঘোর প্রেমে পড়তাম তার ইয়ত্তা নেই৷ আমিও পড়েছি৷ তবে যে সব প্রেম ছিল শিউলি ফুলের বোঁটার মতন রঙিন৷
এই বৃদ্ধ বয়সেও শরৎ এলে চলে যাই সেই ছোট বেলায়৷ সেই সব হিমমাখা সকালের দিনে৷ সেই বাবার দেওয়া একটা হাওয়াই শার্ট । যা গায়ে দিলে কেমন মায়া জেগে উঠত৷ পুজোর দিন গুলিতে মা শরীর পাত করে আমাদের জন্যে বানাত ভাল খাবার।আজ সে সব নেই৷ ভাবি আর মনে মনে গাই ..দিন গুলি আর সোনার খাঁচায় রইল না..। – দেশের সময়