দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ দেশের মানুষকে স্বদেশীর মাহাত্ম্য বোঝাতে গিয়ে কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মনমোহন বসুর লেখা একটি কবিতার লাইন উদ্ধৃত করেছিলেন।
শুক্রবার সংসদের বাজেট অধিবেশনের যৌথ সভায় রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের বক্তৃতায় ফের উঠে এলো বাংলা গানের লাইন—
“চল রে চল সবে ভারত সন্তান মাতৃভূমি করে আহ্বান
বীর দর্পে পৌরুষ গর্বে সাধ রে সাধ সবে দেশের কল্যাণ।”
রাষ্ট্রপতি তাঁর বক্তৃতার শেষে বলেন, বীরত্ব, আধ্যাত্ম আর প্রতিভার ভূমি হল পশ্চিমবঙ্গ। সেখানকারই সুপুত্র গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশপ্রেমের এই তেজস্বী গান লিখেছিলেন। এ কথা বলে, দেশের কল্যাণে স্বাভিমানের সঙ্গে সমষ্টিগত প্রয়াসের আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা লিখে দেয় সরকার। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তা অনুমোদন করে। অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদীর সরকারই এই বক্তৃতা লিখে দিয়েছে।
বাংলায় ভোট আসন্ন। ফলে এই ঘটনাকেও রাজনীতির সঙ্গে জুড়ে দেখতে চাইছেন অনেকে। স্বাধীনতার পর গত সাত দশকে বাংলা ও বাঙালির আবেগ, তার সংস্কৃতি, গান কবিতা জাতীয় মঞ্চে এর আগেও উঠে এসেছে। তবে এরকম ধারাবাহিকতা বজায় রাখার দৃষ্টান্ত বিরল।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “৫ ডিসেম্বর শ্রী অরবিন্দের মৃত্যুবার্ষিকী। অরবিন্দের লেখা যত বেশি পড়া যাবে, ততই আমাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে যাবে। তরুণ প্রজন্ম যত বেশি অরবিন্দ সম্পর্কে জানবে, ততই তারা কিছু শিখতে পারবে। নিজেদের জ্ঞানের ভাণ্ডার তত বাড়বে।” সেই সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “ঋষি অরবিন্দের দেখানো পথে এগোলে নতুন রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাবে’। তাঁর কথায়, “আমরা যখন ‘ভোকাল ফর লোকাল’-এর প্রচার নিয়ে এগোচ্ছি, তখন অরবিন্দের স্বদেশি দর্শন আমাদের পথ দেখাচ্ছে।”
আবার পরে কাশীতে এক অনুষ্ঠানে মনমোহন বসুর লেখা কবিতা উদ্ধৃত করেছিলেন মোদী। স্বদেশির পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে ‘দিনের দিন্ সবে দীন’ কবিতাটির দুটি লাইন পড়ে শুনিয়েছিলেন তিনি—“ছুঁই সূতো পর্যন্ত আসে তুঙ্গ হ’তে, দীয়াশলাই কাটি, তাও আসে পোতে/ প্রদীপটি জ্বালিতে, খেতে, শুতে, যেতে, কিছুতেই লোক নয় স্বাধীন!”
শুধু কি তাই, সম্প্রতি এক দ্বিপাক্ষিক ভার্চুয়াল বৈঠকে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরকে ব্যাকড্রপে রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, হতে পারে এ সবই রাজনৈতিক উদ্দেশে করা হচ্ছে। কিন্তু তাই বা আগে কবে হয়েছে!
In this fight against the pandemic, we lost many citizens. Former President Pranab Mukherjee passed away in this Corona period. Six MPs left us untimely due to COVID. I pay my tribute to all of them: President Ram Nath Kovind, in Parliament#BudgetSession pic.twitter.com/F7TWKgk1Vk
— ANI (@ANI) January 29, 2021
সুপ্রিম নির্দেশকে সম্মান দিয়েই কৃষি আইন স্থগিত রাখবে সরকার: রাষ্ট্রপতি
কৃষি আইনের প্রতিবাদ আন্দোলনে উত্তপ্ত রাজধানীর পরিস্থিতি। তার মধ্যেই সংসদে শুরু বাজেট অধিবেশন। এদিন আর্থিক সমীক্ষা রিপোর্ট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের ভাষণের মাধ্যমে সংসদ অধিবেশনের সূচনা। সংসদের যৌথ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ জুড়ে কৃষি আইন প্রসঙ্গ। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনেই কৃষি আইন আপাতত স্থগিত রেখে বিভ্রান্তি কাটাবে সরকার বলে সংসদের ভাষণে জানালেন রাষ্ট্রপতি। একইসঙ্গে লালকেল্লায় কৃষকদের আচরণেরও নিন্দা করেন কোবিন্দ । তিনি বলেন, ‘কৃষকদের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যেই আমার সরকার কাজ করছে। প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকদের আচরণ দুর্ভাগ্যজনক। ‘
প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন লালকেল্লায় যে তাণ্ডব চলেছে সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘লালকেল্লায় ওইদিন যা ঘটেছে তা তীব্রভাবে নিন্দনীয়। কৃষক আন্দোলনের নামে চলেছে তাণ্ডব। প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনই অপমানিত আমাদের জাতীয় পতাকা। সংবিধান আমাদের স্বাধীনতার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইন মানতেও শিখিয়েছে।’
কৃষি আইন প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘এই সরকারের তৈরি কৃষি আইন ঐতিহাসিক। দেশের প্রান্তিক কৃষকদের কথা ভেবেই নতুন তিনটি কৃষি আইন এনেছে সরকার। দেশের ৮০ শতাংশ কৃষকই বিশেষ কোনও সুযোগ সুবিধা পান না। কৃষি ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হলে দেশের এই প্রান্তিক ও ছোট কৃষকদের উপর নজর দিতে হবে। কৃষকদের সর্বোচ্চ এমএসপি ব্যবস্থা করেছে এই সরকারই। এম এসপি-এর ক্ষেত্রে এবছর রেকর্ড গড়েছে আমাদের দেশ। সরকারের আনা এই তিন কৃষি আইন দেশে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে। একইসঙ্গে কৃষকদের হাতে আসবে অনেক নতুন অধিকার। এই আইন পাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ১০ কোটি কৃষক এর সুফল পেতে শুরু করেন।’
কৃষি আইন ছাড়াও করোনা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘একজোট হয়ে করোনার মোকাবিলা করেছে আমাদের গোটা দেশ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকাকরণ কর্মসূচি চলছে এদেশেই। করোনাকালে দেশবাসীর পাশে সারাক্ষণই ছিল সরকার। মহামারী মোকাবিলার সঙ্গে সঙ্গে গরিব কল্যাণ যোজনার মাধ্যমে আর্থিকভাবে দুর্বল দেশবাসীদের জন্যেও রোজগারের ব্যবস্থা করেছে সরকার। অতিমারির প্রকোপ সত্ত্বেও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সক্ষম হয়েছে ভারত।’
এই প্রসঙ্গেই মোদী সরকারের আত্মনির্ভর ভারতের কথাও উল্লেখ করেন রামনাথ কোবিন্দ। তিনি বলেন, ‘আত্মনির্ভর ভারতের গুরুত্ব আরও বেশি করে বোঝা গিয়েছে এই করোনা পরিস্থিতিতেই। আমাদের দেশের জন্য এটা গর্বের যে আমরা শুধু নিজেদের জন্যই ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম হইনি, অন্য দেশকেই টিকা সরবরাহ করেছি। খুব কম সময়ে মহামারির শুরুর দিকে ভারতেই পিপিই কিট উৎপাদন শুরু হয়। গত ৬ বছরে সরকারের প্রকল্প ও কাজের লাভ মিলেছে এই করোনাকালেই।’
এছাড়া গালওয়ানে মোতায়েন সেনা জওয়ানদের ভূয়সী প্রশংসা করেন রাষ্ট্রপতি। দেশের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নবাদী শক্তিকেও যে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে সরকার তার প্রমাণ উপত্যকায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বলে জানান কোবিন্দ।
তবে ভাষণের শুরুতেই এল করোনা মহামারীতে প্রাণ হারানো মানুষদের শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করেন রাষ্ট্রপতি । তিনি বলেন, এই মহামারীতে প্রাণ হারিয়েছেন দেশের বহু নাগরিক। একইসঙ্গে আমরা হারিয়েছি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। অকাল প্রয়াণ হয়েছে ৬ জন সাংসদেরও ।
কৃষি আন্দোলনের প্রতিবাদে রাষ্ট্রপতির ভাষণ বয়কটের ডাক দেয় ১৬টি বিরোধী দল। কংগ্রেস, এনসিপি, টিএমসি,ডিএমকে , আর জেডি, সিপিআই, সিপিআইএম, সমাজবাদী পার্টি, শিবসেনা, পিডিপি-এর মতো বিরোধী দলগুলি একযোগে বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। তিন কৃষি আইন রাজ্যের স্বাধিকারের উপর আঘাত ও সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী বলে দাবি। সংসদের অভ্যন্তরে এদিন রাষ্ট্রপতি ভাষণেও পড়ে বিরোধিতার আঁচ। ভাষণের মাঝেই বিরোধী সাংসদরা কৃষকদের সমর্থনে লাগাতার ‘জয় জওয়ান জয় কিষান’ স্লোগান দিতে থাকেন।