দেশের সময় ওয়েবডেস্কঃ শব্দ তাঁর পছন্দ ছিল না। বন্দুকও নয়। চেয়েছিলেন, তাঁর শেষকৃত্যে যেন গান স্যালুট না দেওয়া হয়। পরিবারেরও তেমনটাই ইচ্ছে। আর সেই ইচ্ছেতেই সায় দিল রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, শঙ্খ ঘোষের শেষকৃত্যে গান স্যালুট হবে না।
মুখ্যমন্ত্রী এদিন জানালেন, ‘শঙ্খদার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছি। তাঁর পরিবার এবং শুভানুধ্যায়ীদের সকলকে সমবেদনা জানাই। কোভিডে মারা গিয়েছেন শঙ্খদা। তার পরেও যাতে রাষ্ট্রীয় সম্মানের সঙ্গে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা যায়, মুখ্যসচিবকে তেমন নির্দেশ দিয়েছি। তবে শঙ্খদা গান স্যালুট পছন্দ করতেন না। সেটা বাদ রাখছি।’
কবি শঙ্খ ঘোষের মরদেহ নিয়ে শুরু হল শেষযাত্রা। বুধবার নিমতলা মহাশ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য করা হবে। পরিবার সূত্রে খবর, নিমতলায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শুরুর আগে কবির ভাই নিত্যপ্রিয় ঘোষের সল্টলেকে বাড়িতে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে। তার পর সেখান থেকেই নিমতলায় উদ্দেশে রওনা দেবে কবির দেহবাহী গাড়ি।
‘মুহূর্ত এখানে এসে হঠাৎ পেয়েছে তার মানে,
নিজের পায়ের চিহ্ন নিজে আর মনে রাখেনি
আমিও রাখিনি কিছু, তবু হাত রাখে পিছুটান…’
তাঁর জীবনদর্শন ছিল ভিন্ন। শুধুমাত্র প্রকৃতি কিংবা প্রেম নয়, তাঁর লেখনীতে জীবন্ত হয়ে উঠত রূঢ় বাস্তব। রাজনীতি নিয়েও সরব ছিল তাঁর কলম। শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণে শোকের মেঘ ঘনাল বাংলা সাহিত্যের আকাশে। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ছিলেন তিনি। ২০১১ সালে পদ্মভূষণ সম্মানে তাঁকে বরণ করে ভারত সরকার। ২০১০ সালে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২০১৫ সালে শিবপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ডি,লিট পান তিনি।
জন্ম ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বঙ্গের চাঁদপুরে। প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। অবিভক্ত বাংলায় পাবনার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। দেশভাগের পরে চলে আসেন কলকাতায়। ১৯৪৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দু’ বছর পর সেখান থেকেই বিএ পাশ করেন। ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমএ পাশ করেন।
কবিতা চর্চার পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। বঙ্গবাসী কলেজ, জঙ্গিপুর কলেজ, বহরমপুর গার্লস কলেজ, সিটি কলেজ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করেন তিনি। এছাড়াও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, শিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের দায়িত্ব ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছেন নিরন্তর রবীন্দ্র চর্চা। স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্ত্বাই ছিল তাঁর পরিচিতি। অন্যায়ের সঙ্গে কখনওই আপোস করেননি।
১৯৫৩ সালে সাহিত্যজীবন শুরু। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতা ‘দিনগুলি রাতগুলি’। ১৯৫৬ সালে ওই শিরোনামেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি হয়ে ওঠেন সাহিত্য সমালোচকও।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে বরাবরই গর্জে উঠেছে তাঁর কলম। স্বাধীনতার পরে কোচবিহারে খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলি চালানো এবং কিশোরী হত্যার প্রতিবাদে শঙ্খ ঘোষ লেখেন, ‘যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে, বিষের টোপর নিয়ে…।’ কবিতার মাধ্যমে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এ কোন দেশ? মৃত্যু তার স্খলিত অঞ্চল সালে দয়িত মুখে, শিশু তার জন্মে পায় দুর্বল দুয়ারে হাহাকার।’ নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়েও সরব ছিল তাঁর কলম। সাম্প্রতিক রাজনীতিও বিষয় হয়ে ওঠে তাঁর কবিতার।
এদিন কবির মৃত্যু সংবাদ শোনার পর উল্টোডাঙায় তাঁর আবাসনে যান রাজ্যের বিদায়ী পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তাঁর কাছেও পরিবার গান স্যালুট নিয়ে অনিচ্ছার কথা জানান। এর পরেই রাজ্য সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়, রাষ্ট্রীয় মর্যাদাতেই এদিন দুপুরে নিমতলা শ্মশানে কবির শেষকৃত্য হবে।
কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন শঙ্খবাবু। তাই কোভিড বিধি মেনেই হবে শেষকৃত্য। নিয়ম মেনে পুরসভার শববাহী বিশেষ গাড়িতে মরদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে। কোভিড বিধি মেনে সেখানে পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত থাকতে পারবেন। প্রসঙ্গত, শঙ্খবাবুর স্ত্রী, এক মেয়ে, জামাইও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, কুন্তক এবং শুভময় রায় ছদ্মনামেও কবিতা রচনা করেছেন তিনি।
শঙ্খ ঘোষ রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে নিহিত পাতাল ছায়া (১৯৬৭), আদিম লতাগুল্মময় (১৯৭২), মূর্খবড় সামাজিক নয় (১৯৭৪), বাবরের প্রার্থনা (১৯৭৬), তুমি তো তেমন গৌরী নও (১৯৭৮), পাঁজরে দাড়ের শব্দ (১৯৮০), প্রহর জোড়া ত্রিতাল (১৯৮২), বন্ধুরা মাতি তরজায় (১৯৮৪), মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে (১৯৮৪), ধুম লেগেছে হৃৎ কমলে (১৯৮৭), লাইনেই ছিলাম বাবা (১৯৯৩), গন্ধর্বকবিতাগুচ্ছ (১৯৯৪), শবের উপর শামিয়ানা (১৯৯৭), ছন্দের ভিতর এত অন্ধকার (১৯৯৯), জলই পাষাণ হয়ে আছে (২০০৪), সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি (২০০৭) বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়।
ছড়া জাতীয় গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাগ কোরনা রাগুনি (১৯৮৩), সব কিছুতেই খেলনা হয় (১৯৮৮), আমন ধানের ছড়া (১৯৯১), আমন যাবে লাট্টু পাহাড় (১৯৮৮), ওরে ও বায়নাবতী (২০০৩)। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল- সকাল বেলার আলো (১৯৭২), সুপুরি বনের সারি (১৯৯০)।
গত ১৪ এপ্রিল কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। হাসপাতালে যেতে চাননি। সেই কারণেই হোম আইসোলেশনে রাখা হয়েছিল তাঁকে। বুধবার সকাল ৮টা নাগাদ প্রয়াত নবতিপর কবি।