হাত ধরো পরস্পরের…

অশোক মজুমদার

সত্যজিৎ রায়ের ফটিকচাঁদ গল্পে মাদারির খেলা, ফেরিওয়ালার হাঁকডাকে সরগরম ময়দানের বিকেল দেখে অবাক ফটিককে হারুন বলেছিল, “এখানে সবাই বাঁচতে আসে রে ফটিক।”

শুধু ময়দান নয়, আজ প্রায় ৭ মাস হল করোনার দাপটে শহরের বুক থেকে এই বাঁচার চেষ্টার ছবিটা মুছে গেছে। সংগঠিত ক্ষেত্রের বৃত্তিজীবি মানুষদের নিয়ে আমাদের যাবতীয় হৈচৈ। কিন্তু মাঠে ময়দানে, পাড়ায় পাড়ায় যেসব মানুষ নানা জিনিস ফেরি করে; বাঁদর খেলা, ম্যাজিক কিংবা ট্রেনের কামরায় গান শুনিয়ে সামান্যকিছু রোজগার করতেন সেই মানুষগুলো যেন আচমকা উধাও! তারা কোথায় গেল, তাদের বাঁচার চেষ্টা বা জীবন কোনদিকে বাঁক নিলো সে খবর আমরা কেউ রাখিনা। সামাজিক দূরত্ব রক্ষার চাপ তাদের প্রায় জীবন থেকে অদৃশ্য করে দিয়েছে।

সত্যি বলতে কি করোনা আমাদের অভ্যাস, চিন্তাভাবনায়, জীবনযাপনে যে পরিবর্তন আনলো তা এককথায় চমকে ওঠার মত। দাঙ্গা, হাঙ্গামা, রাজনীতি, যুদ্ধ কোনকিছুই আমাদের জীবনে এর আগে এতবড় পরিবর্তন আনতে পারেনি।

কেমন আছেন বাড়িতে কিংবা পাড়ায় রোজ ভিক্ষে করতে আসা অন্ধ ভিখারিটি কিংবা পাড়ার ফুচকাওয়ালা, ভেলপুরিওয়ালারা? ফুটপাথের হকাররা? কী করছেন ট্রেনের হকার, ফল ও সবজি বিক্রেতার মত মানুষেরা? ট্রেনের চাকার স্তব্ধতা তাদের জীবিকাও স্তব্ধ করে দিয়েছে। আমাদের সল্টলেকে সপ্তাহে একদিন হরিনাম করতে আসা বয়স্ক মানুষটি এখন কী করছেন, কীভাবে বাঁচছেন তিনি আমি জানিনা। সংক্রমণের ভয়ে অনেকে বাড়ির কাজের লোকটিকেও আসতে বারণ করেছেন। এদের সবারই আজ জীবন বিপন্ন। এইসব মানুষেরা কীভাবে বাঁচছেন তা ভাবলেও মনখারাপ হয়।

মনে হয়, লকডাউন কিছুদিনের মধ্যেই উঠে যাবে। হয়তো ১১সেপ্টেম্বরই আমরা শেষ লকডাউন কাটালাম। কিন্তু জীবন কবে আগের ছন্দে ফিরবে তা বলা মুশকিল। সত্যি বলতে কি, তা কেউ বলছেনও না। শুধু বলা হচ্ছে ‘নতুন স্বাভাবিকতা’র কথা।

বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় ঘরবন্দী হয়ে থাকতে থাকতে আমরা এক নতুন নিয়মকানুনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। অফিস, পড়াশোনা, কেনাকাটা সবকিছুই এখন অনলাইন। হাতে স্মার্টফোন আর টেবিলে কমপিউটার নিয়ে আমরা জীবনযুদ্ধে জেতার চেষ্টা করছি। রিয়েল থেকে হয়ে উঠছি ভার্চুয়াল।

কিন্তু কখনো ভেবেছি, যারা এসব পারবেন না তারা নতুন স্বাভাবিকতায় কীভাবে বাঁচবেন তা কেউ জানেনা। দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারাও তাদের নিয়ে নীরব। এই গরিব দেশে যারা অনলাইন হতে পারছেন না, তাদের লাইফলাইনটা কী হবে তা নিয়ে টুঁ শব্দটিও করছেন না তারা।

শুনতাম মানুষ ছাড়া রাজনীতি হয়না, করোনা শেখালো মানুষের আর দরকার নেই। অনলাইনে দিব্যি চলছে বাছাই কিছু মানুষের উপস্থিতিতে জনসভা থেকে দলীয় বৈঠক সবকিছু। এমনকি ভোটের প্রচারও! নাচ-গান-কবিতা সবকিছুই এখন ভার্চুয়াল। আমাদের আয় কমেছে কিন্তু করোনাকালে ঘরে ঘরে প্রতিভার বিস্ফোরণ ঘটেছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা এখন সবাই লেখক, গায়ক, কবি এবং চিন্তাবিদ। কোন উৎসব, অনুষ্ঠান বা মহাপুরুষদের জন্মদিন উপলক্ষে ইন্টারনেট বেয়ে তা ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। যে মানুষগুলো হাতে নামি কোম্পানির দামি ফোন নেই, বাড়িতে নেই কমপিউটার, এই আনন্দযজ্ঞে তাদের প্রবেশ নিষেধ। যারা এতে যোগ দিতে পারলেন না তাদের ডাকার কথা কেউ ভাবছেন না।

অতিমারির ধাক্কায় প্রায় ৭মাসে সমাজের একটা বড় অংশের মানুষ বাঁচার লড়াই থেকে ছিটকে গেছেন। দায় এড়াতে আমরা লাশ গায়েব থেকে লকডাউন সব বিষয়েই মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলছি। সুশান্ত’র আত্মহত্যা থেকে শুরু করে রিয়ার মাদক পাচার সব বিষয়ে আমাদের মতামতই চূড়ান্ত!

শুধু ভাবলাম না আমাদের ওপর নির্ভর করে যারা দিন কাটাতো সেই বাড়ির কাজের দিদি, পাড়ার রিকশওয়ালা কিংবা স্থানীয় অটোচালকেরা কীভাবে বাঁচবেন? সেই ব্যাপারে আমাদের কোন মন্তব্য নেই। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের পাশে দাঁড়ানোর কোন উদ্যোগও নেই।

লকডাউনের প্রায় শুরু থেকেই আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী এদের সাহায্য করে চলেছি। এদের অনেকেই এখন আমার ওপর কিছুটা নির্ভর করেন। কিন্তু আমার নিজেরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। বেশিদিন একাজ চালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার অনুরোধ আপনারা সবাই যদি এদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তাহলে আরও বেশি বিপন্ন মানুষকে সহায়তা করা যাবে। সবাই নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী সহায়তার হাত বাড়ালে অনেকটা কাজ হয়। যে মানুষগুলি খুব কষ্টে আছেন তাদের জন্যে একটু ভাবলে বহু মানুষ পায়ের নিচে শক্ত জমি খুঁজে পাবেন।

অতিমারি এক সময় শেষ হবেই। অন্যান্য অতিমারির মত করোনাও থাকবে শুধু মানুষের স্মৃতিতে। কিন্তু মানবতা আর মানবধর্মের কোন শেষ নেই। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে দিয়ে তা জেগে থাকে। আসুন, পরস্পরের হাত ধরে কঠিন সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে দিয়ে আমরা এই মানবধর্মকে বাঁচিয়ে রাখি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here