দেশের সময়,ওয়েবডেস্কঃ আন্তর্জাতিক! ব্রা না-পরার দিন ,এইটুকু পড়েই যারা মনে মনে ‘ডোরাকাটা নারীবাদী’ লেখক বলে ভাবছেন, কিংবা হয়তো যৌনতায় জারিত একখানা লেখা পড়ার আশা করছেন, কিংবা যারা ভাবছেন ‘নো ব্রা ডে’ মানেই ভারতীয় সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিয়ে মেয়েরা ব্রা খুলে উন্মুক্ত বুকে রাস্তায় প্যারেড করবে, তাঁরা কিন্তু হতাশ হতে পারেন। এই দিবসের সঙ্গে নারীবাদের এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের সংযোগ থাকলেও, যৌনতার নেই। সর্বোপরি, এখানে ব্রা শব্দটি বিশেষ ব্যঞ্জনা বহন করে। সে কথায় পরে আসা যাবে।
১৩ অক্টোবর, ব্রা ছাড়া বছরের একটা দিন। কেন ব্রা ছাড়া একটা দিন?
স্তন ক্যানসার অসুখটার সঙ্গে সকলেই পরিচিত আজকের দিনে। বহু মানুষের পরিবারের কোনও সদস্যা বা নিকটাত্মীয়া এই অসুখে ভুগে হয়তো মারা গেছেন। অথবা কিছু ক্ষেত্রে সারভাইভও করেছেন অনেকে। সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সি মহিলাদের প্রতি ৮ জনের মধ্যে ১ জনের তার জীবদ্দশায় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
সেই স্তন ক্যানসার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতেই এই ‘নো ব্রা ডে’ উদ্যোগ শুরু হয় ২০১১ সালে। প্রথমে ৯ জুলাই দিনটিকে এই নো ব্রা ডে হিসেবে পালন করা হতো। পরে, ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর ১৩ অক্টোবর দিনটি ‘নো ব্রা ডে’ হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে।
কারণ, স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস অক্টোবর। এই দিবসটির শুরু কানাডার প্লাস্টিক সার্জেন ডক্টর মিশেল ব্রাউনের মাধ্যমে। ব্রা শব্দের অর্থ অন্তর্বাস হলেও, এ ক্ষেত্রে ব্রা বা BRA উপস্থাপনা করে ব্রেস্ট রিকনস্ট্রাকশন অ্যাওয়ারনেস-কে। এই দিবসের মাধ্যমে তিনি স্তন চিকিৎসা বিষয়ে মহিলাদের সচেতন করার কাজ শুরু করেন। এর পর থেকে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি দেশে এই দিনটি উদযাপিত হয়ে আসছে।
এই নো ব্রা ডে-র আসল বক্তব্য হল, বছরের এই একটি দিন যেন মহিলারা তাঁদের ব্রা খোলেন এবং নিজের স্তন পরীক্ষা করেন। সর্বোপরি, যত্ন নেন স্তনের। স্তন ক্যানসারের লক্ষণসমূহ সম্পর্কে যেন তাঁরা সচেতন হন। সেই ভেবেই এই দিনে সমস্ত মহিলাকে আহ্বান জানানো হয়, সারা দিন ব্রা না পরেই স্বাভাবিক কাজকর্মে অংশ নিতে। আর কেউ যদি ব্রা না পরতে অস্বস্তি বোধ করেন তা হলে যেন অন্তত পার্পল রঙের পোশাক পরেন সহযোগিতা ও একাত্মতা জানাতে।শুধু মহিলাদের নয়, এই পার্পল কালারের পোশাক পরে স্তন৷
ক্যানসারের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজে পুরুষদেরও আহ্বান করা হয়। কিন্তু পার্পল কালার কেন? কারণ, এইডস এবং স্তন ক্যানসারের প্রতীক এক হলেও রঙ ভিন্ন। এইডস এর প্রতীক লাল আর স্তন ক্যান্সারের প্রতীক হচ্ছে পার্পল বা বেগুনি।
অনেকেই ভাবেন, বেশি সময় ধরে ব্রা পরলে, নিয়মিত টাইট ব্রা পরলে, অথবা রাতের বেলায় ব্রা পরে ঘুমোলে স্তন ক্যানসার হতে পারে। এই ধারণা ভ্রান্ত কিনা এখনই বলা যায় না। তবে স্তন ক্যানসারের সঙ্গে ব্রা পরার কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, তার কোনও বৈজ্ঞানিক উত্তর এখনও চিকিৎসকরা দিতে পারেননি। নয়ের দশকে একটি গবেষণায় প্রাথমিক ভাবে ব্রা-কে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকির জন্য কিছুটা দায়ী বলে মনে করা হলেও, পরবর্তী কালে সেটার গুরুত্ব কমে যায়। তবে ঠিক সাইজ়ের ব্রা না-পরা, স্তনকে পরিমিত সময়ের জন্য ব্রা-মুক্ত না রাখা যে শারীরিক সমস্যার কারণ, সে বিষয়ে একমত অনেকেই।
গত বছর ফিলিপিন্সের নারীরা ১৩-ই অক্টোবর দিনটিকে বৃহত্তর লিঙ্গ সমতার দিন হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। নো ব্রা ডে-কেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা ব্রা খুলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন লিঙ্গবৈষম্যের। কারণ তাঁরা মনে করেন, বক্ষবন্ধনী নারীকে দাসত্বের মধ্যে আটকে রাখার স্বরূপ।
আবার এ বছরেরই জুন মাসে সুইৎজারল্যান্ডের কর্মজীবী নারীরা বেতনের সমতা, যৌন হয়রানি আর সহিংসতার প্রতিবাদে আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাঁদের অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন, বক্ষবন্ধনী পোড়ান এবং পথ অবরোধ করেন।
গত কয়েক মাস ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার মহিলারাও ব্রা পরার বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনে নেমেছেন এবং সেই আন্দোলনেরই অংশ হিসেবে তারা নিজেদের ব্রা না পরা অবস্থায় পোশাক পরা ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করছেন।
২০১৪ সালে নেটফ্লিক্সে একটি তথ্যচিত্র রিলিজ করা হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘ফ্রি দ্য নিপল’। সেই তথ্যচিত্রে দেখানো হয়, আমেরিকার কিছু মহিলা স্তন সংক্রান্ত অপরাধ এবং অহেতুক লজ্জা, রাখঢাকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। এর পর থেকেই ‘ফ্রি দ্য নিপল’ ক্যাম্পেইন বিশ্বজুড়ে প্রচার পায় এবং ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ কোরিয়ার এই আন্দোলনও একই উদ্দেশ্যে চলছে।
মোদ্দা বিষয় হল, ব্রা-র সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ না থাকলেও, ব্রা-র বিভিন্ন ক্ষতিকারক দিক আছে। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মেয়েদের শরীর এবং পোশাক সম্পর্কিত ট্যাবু, লজ্জাবোধও। সবচেয়ে বড় কথা, তৃতীয় বিশ্বের উপমহাদেশে আমরা মেয়েরা, ছোটবেলা থেকেই ব্রা সম্পর্কে নানা ভুল ধারণা নিয়ে বড় হই। আমাদের পরিবারের বড়রা এই পোশাকটি পরার সঠিক নিয়ম আমাদের বলে দিতে পারেন না। কারণ এ দেশে মহিলাদের এই পোশাকটি বিশেষ ট্যাবু। এটি লজ্জার, এটি অশ্লীল, এটি লুকিয়ে রাখার জিনিস। তা জনসমক্ষে বের করতে দেওয়া হয় না।
স্নানের পরে ব্রা ধুয়ে রোদে মেলে দেওয়ার উপায় নেই আমাদের। সেটা অন্য কাপড়ের নীচে ঢুকিয়ে মেলতে হয়, যাতে কোনও পুরুষ দেখে না ফেলে। পুরুষের দেখে ফেলার এই আশঙ্কাও কিন্তু হঠাৎই আকাশ থেকে পড়েনি। তারও কারণ রয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এই পোশাক নিয়ে পুরুষদের অশ্লীল রসিকতা, যৌন ফ্যান্টাসি যেন খুবই স্বাভাবিক। তাই লজ্জা। তাই লুকোনো।
এবারে ভাবুন, রোদে ভাল করে না শুকোনো একটা আধভেজা বস্ত্র কী পরিমাণে অস্বাস্থ্যকর হতে পারে? সেই আধভেজা বস্ত্র থেকে কী কী রোগ হতে পারে? এবং আমাদের দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মহিলা, কিশোরীই এই রকম অস্বাস্থ্যকর কাপড় পরে সারাজীবন কাটিয়ে দেন।
শুধু তাই নয়। এ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ কিশোরীই ব্রা পরতে শুরু করার সময়ে তার সঠিক সাইজ জানতে পারে না। কারণ তাকে কেউ সাইজ বোঝার মতো করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে দেয় না। ফলে নিজের মতো করেই টাইট ব্রা পরে দম আটকানো অবস্থায় সে স্কুল, বাড়ি, টিউশন যায় অনেক সময়েই। আর একটা কারণও আছে টাইট ব্রা পরার ক্ষেত্রে। প্রতিটা মেয়েরই যখন কিশোরীবেলা থেকে স্তনের আকার একটু একটু করে বাড়তে থাকে, তখন তাকে এই সমাজব্যবস্থা, বিজ্ঞাপন, মিডিয়া– সবাই মিলে বোঝায়, তার স্তন যত সুডোল ও আঁটসাঁট হবে, ততই সে হবে আকর্ষণীয়া।
ফলে অনেকেই অন্ধের মতো বিশ্বাস করে বা তাদেরকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয় যে, টাইট ব্রা না পরলে স্তন ঝুলে যাবে এবং তাতে খুব খারাপ দেখাবে মেয়েদের। কারণ স্তন ঝুলে গেলে তো সব শেষ! ঠিক যে ভাবে ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন দিয়ে বোঝানো হয় ফর্সা হওয়াই একটা মেয়ের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য, তার মেধা, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা না থাকলেও হবে, রঙ ফর্সা হলেই কেল্লা ফতে, তেমনই তাদের সমস্ত মেধা, বুদ্ধি, সম্মানও ওই স্তনেই রাখা থাকে বুঝি!
এই সে দিন ফেসবুকেই দেখলাম জহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির বিজয়ী এসএফআই ছাত্রী ঐশী ঘোষের স্তন নিয়ে নোংরা মিম ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। তার কত কত লাইক, কত কত শেয়ার! শিউরে উঠতে হয় এই মধ্যযুগীয় মানসিকতায়।
এখানেই আমার ব্যক্তিগত একটা ঘটনার কথা বলি। ক্লাস টুয়েলভ্ অবধি আমি ব্রা পরতাম না। পরলে অস্বস্তি হত, দম আটকে আসত। স্পোর্টস গেঞ্জি পরতাম শার্টের ভেতরে। প্রাইভেট টিউশন ব্যাচে আমারই সহপাঠী মেয়েরা তা নিয়ে নানা রসিকতা, খিল্লি, বডিশেমিং করত। তা হলে নিজের স্তনকে আকর্ষণীয় করে তুলতে, পুরুষশাসিত সমাজে সুন্দর ও আকর্ষণীয় মেয়ে হয়ে উঠতে, নিজেদের অস্বস্তি, অসুবিধার তোয়াক্কা না করে তারা টাইট ব্রা পরবে না কেন?
এর পাশাপাশি রয়েছে লজ্জাবোধ, বিব্রতবোধ। বহু মহিলা-কিশোরী এখনও ভাবেন, ব্রা না পরলে জামার ওপর দিয়ে তাদের স্তনবৃন্ত ফুটে উঠলে অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থা হবে। কারণ ছোট থেকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তো তাদের মাথায় গেঁথে দিয়েছে, মেয়েদের শরীরের এই অঙ্গটিই খুব লজ্জার। তাই সেই অঙ্গের উন্মুখ অংশটিকে এমন ভাবে লুকিয়ে রাখতে হবে, যেন মনে হয় তোমার স্তনবৃন্তই নেই!
অথচ ভেবে দেখুন, মানুষ হিসেবে প্রত্যেকটা মেয়েরই অধিকার রয়েছে নিজের আরাম অনুযায়ী পোশাক পরার। দেখতে খারাপ লাগবে ভেবে নয়, কোনটা শরীরের পক্ষে আরামদায়ক সেটা ভেবেই পোশাক নির্বাচন করার অধিকার আছে তাদের। সেই অধিকারবোধকেই স্বীকৃতি দেয় এই নো ব্রা ডে। মুক্তির কথা বলে, সচেতনতার কথা বলে। মনে করিয়ে দেয়, এক জন মানুষের মেধা, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি, শিক্ষা, রুচি, সংস্কৃতি, মানবিকতা কিছুই নির্ভর করে না স্তনের আকার ও গঠনের উপর।
তাই প্রতি বছর আসে এই নো ব্রা ডে। এই দিনটা মনে করিয়ে দেয় মহিলাদের নিজের শরীরের সুস্থতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি, দেখতে কেমন লাগছের থেকেও বেশি। নিজের শরীরকে ভালোবাসার দিন এটা, সম্মান করার দিন।