![](https://deshersamay.com/wp-content/uploads/2021/11/IMG-20211122-WA0009-1024x853.jpg)
![](https://deshersamay.com/wp-content/uploads/2021/11/1637833499209-1024x597.jpg)
![](https://deshersamay.com/wp-content/uploads/2021/11/1637833249298.jpg)
“ফলসা-বনে গাছে গাছে
ফল ধরে মেঘ করে আছে,
ঐখানেতে ময়ূর এসে
নাচ দেখিয়ে যাবে।”
রবি ঠাকুরের শিশু ভোলানাথ’ কাব্যের ‘দুয়োরানী’ কবিতা অনবধানে মনে পড়ে যায় ফলসার নাম করলেই। তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি, ফলসা গাছ তার আগে দেখিনি। কিন্তু ফলসা গাছের একটি কল্পিত মূর্তি-প্রতিমা যেন অনুভব করতে পারতাম। ধূসর-কালো অজস্র ছোটো ফলে ভরে আছে বড়সড় সবুজ পাতার কক্ষ।
![](https://deshersamay.com/wp-content/uploads/2021/11/1637833441247.jpg)
দিদা গল্প করে বোঝালেন কেমন এই গাছ। বাবা রহড়া বাজার থেকে একদিন গ্রীষ্মের সকালে এনে দিলেন এক ঠোঙ্গা ফলসা। নেড়েচেড়ে দেখি। গন্ধ শুঁকি। তারপর ধুয়ে মুখে দিই। তখনও গাছটি দেখা হয় নি। ক্লাস ফোর। বন্দীপুর হেল্থ সেন্টারের দিকে যেতে ওই এলাকাতেই পুকুরপাড়ে একটি বড় গাছ দেখতে পেলাম। পানের মতো বড় পাতা, খাঁজকাটা তার অবয়ব, পাতার শিরাগুলি উচ্ছল। তখন শীতকালের বিকেল। শাখাপ্রশাখা জুড়ে হাল্কা হলুদ পাতার সম্ভার। তখন তো ফুল-ফলের সময় নয়, কিন্তু গাছখানি আলাদা করে ডাক দিলো আমায়। কী গাছ ওটা, আগে তো মিশনপাড়ায় দেখি নি, কোথাও দেখি নি! দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাটে বসতে যাওয়ার আগে সূর্যের শেষ কিরণখানি দুই একটি ডালপালায় পড়ে চকচক করছে। পথ-চলতি জিজ্ঞেস করলাম — মাসি, কী নাম এর? ও বাবা, ফলসা গো, খাও নি আগ? খেয়েছি মাসি, কিন্তু গাছ দেখিনি আগে৷ মনে মনে যা ভেবে রেখেছিলাম, এইবেলা মিলিয়ে নিলাম। ‘কী মেলালে গো বাছা?’ ‘রবি ঠাকুরের কবিতা গো মাসি! এবার ময়ূর নাচলেই হয়!’ ‘ও মা, মন-ময়ূর নাচলে হবে না!’ মাসি আশা ভোঁসলের গান এক কলি শুনিয়ে চলে গেলেন। “নাচ ময়ূরী নাচ রে, রুম ঝুমা ঝুম নাচরে।”
![](https://deshersamay.com/wp-content/uploads/2021/11/annapurna-car-bazar-new-ad-1-1024x768-1.jpg)
তারপর আরও কয়েক জায়গায় দেখেছি এই গাছ। প্রতি গ্রীষ্মে, একবার অন্তত রহড়া-খড়দার বাজার থেকে ফলখানি কিনে এনেছি। অধিকাংশ সময় অরণ্য ষষ্ঠীর আগের দিন, ছোটো ছোটে থোকায়। তাতে দুই একটা সবুজ কাঁচা ফলের সঙ্গে কালো, ধূসর-বাদামি পাকা ফল। ষষ্ঠীয় পুজোয় মা পাঁচ-ফলের এক ফল হিসাবে গ্রীষ্মের দেবীকে বরণ করে নেন। এটিই প্রকৃতি-পুজো।
ডালায় সবকটি ফলই থোকায় থোকায় থাকা চাই। আমি থোকা-ওয়ালা ফলসা কিনি, কিনি থোকায়-পুষ্ট বুনো খেজুরের আটি, এক গোছা কাঁচা-পাকা থোকা জাম, এক থোকা জামরুল আর এক ফণা কাঁঠালি কলা। জাম না পেলে পাকা করমচার থোকা কিনতে হয়। পাশের বাড়ি থেকে বাঁশের পাতার কোঁড় তুলে আনি, তুলি দূর্বাদল, পুজোর ফুলও। সঙ্গে থাকে বাঁশের একখানি নতুন ঝাঁকা বা কুলো আর একখানা নতুন পাখা। পুজো হয়ে গেলে ফলের গোছা সমেত পাখার ভিজে-জলীয় বাতাস দেন মা। বলেন, ‘ষাট ষষ্ঠী, ষাট ষষ্ঠী’ আর যোগার দেন। সেদিন অখণ্ড আম আর গোটা কলা পাই। আর এক পোয়া দুধের বাটি। পেট ভরে যাওয়ার পর মাঠে গিয়ে দু’টো ফলসার মুখশুদ্ধি মুখে নিই।
![](https://deshersamay.com/wp-content/uploads/2021/11/2020-12X5-copy-1024x427-1-1024x491-1.jpg)
একবার দিদা মুখশুদ্ধির ছোটো ছোট গুলি বানিয়ে কাঁচের বয়মে রেখেছিলেন। কী সুন্দর যে খেতে হয়েছিল, কী বলবো! তাতে ছিল বীজ ফেলে দিয়ে পাকা ফলসার শাঁসের সংগ্রহ, ছিল টক আনার-দানার গুঁড়ো, কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা কালো হয়ে যাওয়া পুরোনো তেঁতুল, শুকনো আমলকি ভেজানো ক্বাথ, কচি আমসির গুঁড়ো, সঙ্গে মধু, আদাবাটা, গোলমরিচের গুঁড়ো। সেই মুখশুদ্ধির স্বাদ আর জীবনে কখনো পেলাম না। মনে হয় পাকা ফলসার শাঁস ছিল না বলে এমনটা হচ্ছে। কী জানি! একবার মনে হয়, ঘরোয়া ভাবে পাকা ফলসা প্রসেসিং করে জ্যাম-জেলি বানাই, বানাই দিদার তৈরি ওইরকম স্বাদু এ-ক্লাস মুখশুদ্ধি। গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, পঞ্চাশ গ্রাম এমন একটি কাঁচের শিশির দাম আড়াইশে টাকা হলেও মানুষ কিনবেনই। তাতে হারিয়ে যাওয়া এই ফলের স্বাদ ও তার সঙ্গে গাছটিও সংরক্ষিত থাকবে। কী গাছটি বাঁচাতে পারবো না?
![](https://deshersamay.com/wp-content/uploads/2021/11/6321050549918739539_121.jpg)
গাছের পরিচিতি — Phalsa, Botanical nane: Grewa asiatica Mast., Family: Tiliace, Type of fruit: Drupe.
এই ছবিটি সংগৃহীত হয়েছে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত মণ্ডৌরী ফল গবেষণা কেন্দ্রের গৌণ ফলের বাগান থেকে ২০২১-এর গ্রীষ্মকালে। (কৃতজ্ঞতা স্বীকার ICAR-AICRP on Fruits, BCKV, Mohanpur)
![](https://deshersamay.com/wp-content/uploads/2021/11/1634548855620.jpg)