দেবন্বিতা চক্রবর্তী ঃ বাংলার রথযাত্রার মধ্যে অন্যতম নাম গুপ্তিপাড়ার রথ৷ বিডিন্ন মতভেদ থাকলেও ১৭৪০ সালে এই রথ উত্সব শুরু হয় বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। সূচনা করেন মধুসুদানন্দ নামে এক ভক্ত। ভাণ্ডার লুট গুপ্তিপাড়ার রথের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। সেই গল্পটা একটু বাদেই জানাই..। তার আগে জানাই, পুরীর রথের সঙ্গে গুপ্তিপাড়ার রথের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল! পুরীর রথকে জগন্নাথ দেবের রথ বলে কিন্তু গুপ্তিপাড়ার রথকে বৃন্দাবন জীউর রথ নামে ডাকা হয়৷
কথিত আছে লক্ষ্মীর সঙ্গে মন কষাকষি হওয়ায় প্রভু জগন্নাথ লুকিয়ে মাসির বাড়ি এসে আশ্রয় নেন। সেখানে সুস্বাদু খাবার পেয়ে জগন্নাথ মাসির বাড়িতেই থেকে যান। অন্য দিকে, লক্ষ্মীর মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। তিনি ভাবেন, স্বামী বোধহয় পরকীয়ার টানে কোথাও চলে গিয়েছেন। পরে তিনি বৃন্দাবনের কাছে জানতে পারেন যে, জগন্নাথ মাসির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তারপরেই স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে লক্ষ্মী লুকিয়ে গিয়ে মাসির বাড়িতে সর্ষে পোড়া ছিটিয়ে আসেন। কিন্তু, তাতেও কোনও কাজ না হওয়ায় বৃন্দাবন ও কৃষ্ণচন্দ্র লোকজন নিয়ে মাসির বাড়িতে হাজির হন।
সেখানে গিয়ে তারা দেখেন যে ঘরের তিনটি দরজাই বন্ধ। তাই লক্ষ্মীর অনুরোধে তাঁর স্বামীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরজা ভেঙে বৃন্দাবন ও কৃষ্ণচন্দ্র ঘরের ভিতরে ঢোকেন। ঘরের ভিতরে ঢুকেই তাঁরা দেখতে পান মালসায় করে রকমারি পদের সুস্বাদু খাবার সাজানো রয়েছে। চোখের সামনে সেই সব দেখে তাঁরা সমস্ত মালসা তৎক্ষনাৎ লুট করেন। যা ভাণ্ডার লুট নামে আজও সকলের কাছে পরিচিত।
গুপ্তিপাড়ার এই ভাণ্ডার লুট নিয়ে অবশ্য অন্য ব্যাখ্যাও রয়েছে। অনেকে দাবি করেন, গুপ্তিপাড়ার রাজা বৃন্দাবন চন্দ্রের প্রচুর ধনসম্পত্তি ছিল। রাজা তার রাজ্যের শক্তিমানদের চিহ্নিত করার জন্য এই ভাণ্ডার লুটের আয়োজন করেন। যাঁরা বেশি সংখ্যায় ভাণ্ডার লুট করেন তাঁদের বৃন্দাবন চন্দ্র তাঁর মন্দির পাহারার দায়িত্বে নিয়োগ করতেন।
তবে প্রথা চালুর কারণ নিয়ে নানা মত থাকলেও প্রাচীন সেই রীতি মেনে এখনও প্রতিবছর উল্টোরথের আগের দিন মাসির বাড়ির মন্দিরের তিনটি দরজা একসঙ্গে খোলা হয়। ঘরের ভিতর রকমারি খাবারের পদ মালসায় করে সাজানো থাকে। দরজা খোলার পরে এই প্রসাদ নেওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। চলে লুটপর্ব। এই মালসা ভোগ পাওয়ার জন্য দূরদূরান্ত থেকে হাজারে হাজারে মানুষ উল্টোরথের আগের দিন গুপ্তিপাড়ায় হাজির হন।
ভাণ্ডার লুটের দিনে পদও থাকে অনেক। ৫২ পদ রান্না হয়। গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, কুমড়ো ভাজা, ছানার রসা, পায়েস, ক্ষীর, ফ্রায়েড রাইস, মালপোয়া, সন্দেশ, রাবড়ি কিছুই বাদ যায় না। ৫৫০ টি মালসা তৈরি করা হয়। প্রতিটি মালসা প্রায় ৫ থেকে ৮ কেজি করে খাবার থাকে। এই কর্ম যজ্ঞের জন্য ১০ জন রাঁধুনি ও ১০ জন হেল্পার সহ মোট ২০ জন রান্নার কাজ করেন। নিয়ম মেনে দুপুর দু’টোর আগেই সমস্ত খাবার তৈরি করে মালসায় সাজিয়ে মাসির বাড়িতে রাখা হয়। বিকেল ৩টেয় মাসির বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এর পরে দরজা ভেঙে চলে লুট।
এই উৎসবের জন্য সারাটা বছর মুখিয়ে থাকে গুপ্তিপাড়া-সহ আশপাশের গ্রাম-শহর। সারা বছর এখানকার চারতলা পাঁচ চুড়ার রথটি থাকে বৃন্দাবনচন্দ্র মাঠের পাশে। আর রথের দিনে গোসাঁইগঞ্জে গুণ্ডিচা বাড়িতে যায় রথ। ফিরে আসে ভাণ্ডার লুটের পরে উল্টো রথে।