দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার আরাধনা যেন এই বঙ্গভূমিতে নিয়ে আসে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উত্‍সব দুর্গাপুজোর আগমন বার্তা। কথিত আছে, যুগে যুগে ভূভারতের যতরকম সুন্দর নির্মাণশৈলী তৈরি হয়েছে, সবটাই নির্মাণ করেছেন বিশ্বকর্মা। এই দেবতার হাত ধরেই ধরিত্রীতে পুষ্পক বিমান, দ্বারকা নগর, যমপুরী, কুবেরপুরী নির্মিত হয়েছে। রামায়ণে বর্ণিত অপূর্ব শোভা ও সম্পদবিশিষ্ট লঙ্কা নগরীর নির্মাতাও বিশ্বকর্মা বলেই কথিত। তিনি উপবেদ, স্থাপত্যবেদ ও চতুঃষষ্টিকলারও প্রকাশক। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে পালিত হয় এই দেবতার পুজো।

অন্যান্য দেব-দেবীর পুজোর মতোই বিশ্বকর্মা পুজোরও বিশেষ বিধি রয়েছে। সঠিক পন্থায় পুজো করলে সন্তুষ্ট হন দেবতা। ফলও মেলে বেশি। এমনটাই বলছে শাস্ত্র। এবার জেনে নেওয়া যাক কী সেই বিধি।

বিশ্বকর্মা পুজোয় দীপ, ধুপ, জল ও পৈতে লাগবেই। এছাড়াও পুজোর সামগ্রীতে অবশ্যই থাকা চাই চন্দন, পরামর্শ জ্যোতিষবিদদের।
অন্য পুজোর মতোই ফুল দিয়ে দেবতার আরাধনা করতে হবে। এক্ষেত্রে জ্যোতিষবিদরা দেবতাকে সাদা ফুল অর্পণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন।

ছোটবেলা থেকেই দুর্গাপুজোর আগমন ঘণ্টা হিসেবে জড়িয়ে আছে বিশ্বকর্মা পুজো। তখন থেকেই বিশ্বকর্মা পুজো ঘিরে একটা প্রশ্ন মনে বারবার উঁকি মেরেছে। তা হল, অন্য সব দেব-দেবীর তিথি মেনে হওয়ায় ক্যালেন্ডারে কোনও নির্দিষ্ট দিন না থাকলেও কেন বিশ্বকর্মা পুজো প্রায় প্রতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর উদযাপিত হয়?

বিদ্যার দেবী সরস্বতী, অর্থের দেবী লক্ষ্মী বা শক্তির দেবী দুর্গা-কালী সবার পুজোরই কোনও বাঁধা ধরা তারিখ নেই। কিন্তু শিল্পের দেব বিশ্বকর্মার পুজো মানেই ১৭ সেপ্টেম্বর। ইংরাজি ক্যালেন্ডারে এই দিনটি কেন স্থির তা জানতে একটু পঞ্জিকা উলটে দেখতে হবে।

হিন্দু ধর্মে সব দেব-দেবীরই পুজোর তিথি স্থির হয় চাঁদের গতি প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। এ বিষয়ে চান্দ্র পঞ্জিকা অনুসরণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বিশ্বকর্মার পুজোর তিথি স্থির হয় সূর্যের গতি প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে। যখন সূর্য সিংহ রাশি থেকে কন্যা রাশিতে গমন করে, তখনই সময় আসে উত্তরায়ণের। দেবতারা নিদ্রা থেকে জেগে ওঠেন এবং শুরু হয় বিশ্বকর্মার পুজোর আয়োজন। হিন্দু পঞ্জিকার দুই প্রধান শাখা সূর্যসিদ্ধান্ত এবং বিশুদ্ধসিদ্ধান্ত- উভয়েই এ বিষয়ে একমত।

আরও একটু স্পষ্ট করে বলতে হলে, বিশ্বকর্মার পুজোর দিন ভাদ্র মাসের শেষ তারিখে নির্ধারিত। এই ভাদ্র সংক্রান্তির আগে বাংলা পঞ্জিকায় পাঁচটি মাসের উল্লেখ মেলে। এই পাঁচটি মাসের দিন সংখ্যাও প্রায় বাঁধাধরাই- সাকুল্যে ১৫৬টি দিন! এই নিয়ম ধরে বিশ্বকর্মা পুজোর যে বাংলা পঞ্জিকা মতে তারিখটি বেরোয়, তা ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ১৭ সেপ্টেম্বরেই পড়ে। কোনও কোনও বছরে এই পাঁচ মাসের মধ্যে কোনওটা যদি ২৯ বা ৩২ দিনের হয়, একমাত্র তখনই বিশ্বকর্মা পুজোর দিন পিছিয়ে বা এগিয়ে যায়। তবে তা খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা।

শাস্ত্র মতে বিশ্বকর্মা দেবের পুজোয় কপালে টিকা লাগানো জরুরি। কেন? টিকার অর্থ কী? টিকার অর্থ হল দেবতার সামনে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি রাখা। দেবতার প্রতি নিবেদিত প্রাণ হওয়ার প্রতিশ্রুতির প্রমাণ চিহ্নও টিকা। এসব কারণেই বিশ্বকর্মা পুজোয় সিঁদুরের টিকা দেওয়া শুভ।


বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাড়িতে থাকা যন্ত্রপাতি, সরঞ্জামের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচত, মনে করেন শাস্ত্রজ্ঞরা। সেগুলি কী? ইলেকট্রিকের কাজে লাগে, এমন সরঞ্জাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা বাঞ্ছনীয়। যন্ত্রপাতিগুলিকে অয়েলিং করে, ধুয়ো মুছে রাখা উচিত। এর ফলে এইসব যন্ত্রপাতি ভালও থাকে সারা বছর। ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে সুবিধা হয়।
তবে ঘরের যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম সংক্রান্ত অন্য নিয়মও রয়েছে। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাড়ির যন্ত্রপাতি, রান্নাঘরে ব্যবহৃত সরঞ্জাম কাউকে দেওয়া উচিত নয়।

এই বছরেও নিয়মের অন্যথা হয়নি। সূর্য নিয়ম মেনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কন্যা রাশিতে। ভাদ্র সংক্রান্তির আগে বাংলা পঞ্জিকার পাঁচটি মাসের দিনসংখ্যাও ১৫৬টিই থেকেছে এবং ১৭ সেপ্টেম্বর উদযাপিত হতে চলেছে বিশ্বকর্মা পুজো। আকাশ রঙিন হয়ে উঠবে ঘুড়ির সম্ভারে। আসন্ন উত্‍সবের সূচনার বার্তা নিয়ে আসছে তারা।এছাড়াও বিশ্বকর্মা দেবের পুজোর দিনে অচেনা কারোর থেকে খাবার নিয়ে ঘরে রাখতে নেই, বলছেন বহু জ্যোতিষবিদ। কেন? এতে কী হয়? এর ফলে পুজোর দিনে নেতিবাচক এনার্জি ঘরে প্রবেশ করতে পারে, যা কেউ চায় না। বিশ্বকর্মা পুজো শেষে হোমের প্রসাদ সকলকে বিতরণ করা বাঞ্ছনীয়।

এই সব নিয়ম আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে পালন করলে দেবতা তুষ্ট হন। ফলও মেলে বেশি। এবং অবশ্যই উচ্চারণ করতে হবে মহামন্ত্র। সেটি হল দেবশিল্পি মহাভাগ দেবানাং কার্য্যসাধক। বিশ্বকর্মন্নমস্তুভ্যং সর্বাভীষ্টপ্রদয়ক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here