‘ট্রাভেলগ’ (পর্ব-১২)
দেবন্বীতা চক্রবর্তী:
বিদায় বেলায়…..
ধীরে চলনা হ্যায় মুশকিল তো জলদি হি সহি….
সত্যি মনে হচ্ছে বড্ড দ্রুত শেষ হয়ে গেল আমাদের এই সফরটা ৷ অমৃতসরে শেষ দিনটা রবিবার , রাস্তাঘাট অনেকটা ই ফাঁকা, সকাল বেলা আরও একবার ঢু মারলাম স্বর্ণমন্দিরে, বিদায় জানাতে , আর মনের সব কালীমা ধুয়ে ফেলে আবার যাতে বারে বারে ফিরে আসতে পারি এই সব পবিত্র তীর্থস্থানে তার জন্য অঙ্গীকার বদ্ধ হতে ৷তবে মন খারাপ করে মখ শুকিয়ে তো চলা যাবে না ওই দিকে উদরগহ্বর ও বিদ্রোহ করতে শুরু করে দিয়েছে ৷
চট করে ঠিক করে নিলাম অমৃতসর স্পেশাল কিছু খেয়ে দেখি , যেমন ভাবা তেমন কাজ, সম্পূর্ণ নিরামিষ হোটেলে অর্ডার দিতেই হাজির গরম গরম চা আর অমৃতসরি কুলচা, এর চেয়ে উপাদেয় ব্রেকফার্স্ট আর কি বা হতে পারে? সাথে ঘুরে নিলাম শপিং প্লসটাও ,মনপসন্দ শৌখিন পাতিয়ালা খ্যাত শাল, সোয়েটার আর নাগরা দেখে আর স্থির থাকা গেল না , বিশেষ করে আমরা মহিলারা একটু শপিং না করলে
যেন হাঁপিয়ে পড়ি ওটা আমাদের জন্মগত ….
সব কিছুর পর চটজলদি সবাই গাড়িতে চড়ে মাত্র ২ কিমির মধ্যে স্টেশনের পাশে পৌঁছালাম ১৬ শতকের দুর্গিয়ানা টেম্পলে ৷ এখানে প্রশস্ত মন্দিরে শ্বেত পাথরে দেবী দূর্গা পূজিত হন , বংশপরম্পরায় বাঙালি পুরোহিতরা তার পূজা অর্চনা করে থাকেন ।
মন্দিরের ধাঁচ সেই স্বর্ণমন্দিরের মতোই ৷ দূর্গামাতা ছাড়াও এখানে আছে লক্ষ্মী নারায়ণ ও হনুমানের মন্দির ।মাতৃরূপে মায়ের পূজোর রীতি অনুসারে মহিলাদের প্রসাদের এক উত্তম ব্যবস্থাপনা নজরে এল আমাদের ৷
গাড়ি থেকে বসেই দেখতে হল গোবিন্দগড় দূর্গ ,যা রানা রণজিৎ সিং তৈরী করেন ১৮০৫-০৯ সালের মধ্যে
, এটি প্রথম শিখ দূর্গ গন্য করা হয় ৷এখন ভারতীয় সেনা বাহিনী এই দূর্গ রক্ষা করছেন ৷
আমরা আর বেশী সময় না নিয়ে সোজা চললাম রামতীর্থের উদ্দেশ্যে । ১৬ কিমি পশ্চিমে এই তীর্থস্থান , গল্পশুনে তো আমাদের চোখ কপালে উঠে গেল ৷কিংবদন্তি ঋষি মহর্ষি বাল্মীকি মুনির আশ্রম ছিল এখানে আর এখানের জন্মগ্রহন করেন রামচন্দ্রের দুই জমজ পুত্র লবকুশ । ভাবা যায়……পুরাণ, ইতিহাস, স্থাপত্য, ট্র্যাজিক ক্যারেকটার তার পর আবার রামায়ণ ……কি নেই আমাদের এই সাত দিনের ভ্রমনে ৷ যাই হোক মুখের হাঁ ভাবটা কোনো রকম সামলে নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করলাম ৷ চারপাশে সরোবর ও মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গেরুয়া রঙের নয়নাভিরাম মন্দির ৷সরোবরটি পরে ১৫৯৬ সালে তৈরী করেন রণজিৎ সিং স্বয়ং ৷ কথিত আছে সাঁতরে পুরো সরোবর টি পেরিয়ে আসলে কুষ্ঠরোগ সেরে যায় ৷
রামতীর্থ প্রদক্ষিণ করতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লাগে , আমাদের হাতে ছিলোও তায় । ফেরার ট্রেন ধরার তাড়া
ছুটিয়ে মারছে আমাদের ৷ মন যেন ফিরতে চাইছে না ঘরে, উদাস হাওয়ায় মন বাউলপারা হয়ে মিশে যেতে চাইছে এই হাজার লোকের ভিড়ে ৷ কিন্তু …ফিরতে আমাদের হবেই ৷
পথেই ছেড়ে যেতে হবে আমাদের হাসি, মজা, সাসপেন্স এভরা দিন গুলো ৷ ফেলে যেতে হবে নিয়ম ভাঙার উচ্ছাস…..কুড়িয়ে পাওয়া কিছু মানুষের হাসি , গল্প , অচেনা কে আপন করে নেওয়ার আসাধারন ক্ষমতা আর তাদের পরোপকারিতা ….. আমরা ফেলে চলেছি আমাদের হারিয়ে যাওয়ার মূহূর্ত গুলো, ইচ্ছে খুশিমতো নিজেদের হারিয়ে ফেলে আবার ফিরে আসা ।গাড়ি ছুটে চলেছে কালকার পথে …সেই কালকা , যেখান থেকে এই দীর্ঘ পথ যাত্রার শুরু ৷ আমাদের সঠিক পথে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে আমা
দের সাথে বাকি ৫ টি দিন কাটালো সেই কঠোর পরিশ্রমী আমাদের সারথী দিলবর
কে ধন্যবাদ জানালাম সবাই মিলে , সেও দেখলাম আমাদের ঘরের ছেলে হয়ে উঠেছে কখন | মাইয়া বলে কখন যেন মহিলা মহলকে হাত করে নিয়েছে ….তবে মন জয় করেছে সবারই , কারন সে না থাকলে সেই দুঃসাহসী রাত জঙ্গলের মধ্য পাড়ি দেওয়া অসম্ভব ছিলনা ৷চন্ডীগড় পেরোতে প্রায় রাত ৮ টা বাজল ।
আমরা উঠলাম ভাকড়া ড্যামের লম্বা সেতুতে চালকের আসন থেকে সে আমাদের ডেকে দেখালো তা , নীচে বয়ে চলেছে বিয়াস ।
এই বিয়াস বা বিপাশা কে আমরা পেয়েছি সিমলা ও মানালিতে ৷ এই কয়েকদিনে যেন ভুলতে বসেছিলাম আমাদের কাজকর্ম ,দায়িত্ব কর্তব্যের পরিচিত জগৎটা ৷বদলে ঢুকে পড়েছিলাম এক ঐতিহাসিক রাজ্যে যার কাছে জমা আছে ভারতের বিভেদের মধ্যে ঐক্যের এক সুদৃঢ় বন্ধনের বার্তা ।
যেতে যেতে পথ শেষ হল আমাদের , কালকা স্টেশনে পৌঁছালাম রাত ঠিক ১১.০৫ এ । কালকা হাওড়া মেলের টাইম ১১.৩০ টাই । এই গোটা পথটা অসাধারন পাহাড়ী দক্ষতায় যে পৌঁছে দিল তার ঋণ যেমন শোধ করার নয় তেমন ই কৃতজ্ঞ দেশের সময়ের সমস্ত পাঠক পাঠিকার কাছে যারা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে আমাদের গোটা জার্নির সাক্ষী রইলেন ৷
মনের মধ্যে যখন ই উঠবে না পাওয়ার কষ্ট, বেদনা ,হতাশা সে যেকোনো বিষয়েই হোক …..হাতের কাছে যে সাইজের ব্যাগ পাবেন …সে বড় ট্রলি হোক বা ছোটো রুকস্যাক ….গুছিয়ে নিয়ে মানে মানে কেটে পড়ুন সব কিছু ছেড়ে …শুধু বেঁচে থাকার আনন্দে নিজের দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে বলুন
” উড়ে খুলে অাসমামে খোয়াবো কে পরিন্দে…
ক্যা পাতা যায়েন্গে কাহা ……অব তে যোভি হোস হো …..” (শেষ)৷