অশোক মজুমদার
একই পেশায় থাকা সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিকরা আজ শহরে দু’জায়গায় বাগদেবীর আরাধনা করছেন। সাংবাদিকরা করছেন প্রেস ক্লাবে, কলকাতার সুসজ্জিত এলাকায়। আর বহু অনুরোধ ও আবেদন-নিবেদনের পরও কোন উপযুক্ত যুক্তি ছাড়া ক্লাবের সদস্যপদ থেকে বঞ্চিত চিত্রসাংবাদিকরা পুজো করছেন এসপ্লানেড ইস্ট এর ফুটপাথে! এই ঘটনায় অনেকে বিস্মিত হতে পারেন কিন্তু এটাই বাস্তব। সরস্বতী পুজোর দিন দেবীর সেবকদের পুজোর স্থানের এই অবস্থান সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিকদের চিরকালীন বৈষম্যকে আবার সামনে নিয়ে এল।
দেশের প্রতিটি প্রেস ক্লাব এর সাংবাদিকদের পাশাপাশি চিত্রসাংবাদিকদেরও সাধারণ সদস্যপদ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এমনকি রয়েছে ভোটাধিকারও। ক্লাবের সব সুবিধাও তারা সমানভাবে ভোগ করেন। ব্যতিক্রম প্রেস ক্লাব, কলকাতা! এখানকার কর্তাদের একটাই যুক্তি, এটাই বহুদিন ধরে চলে আসছে। আমরা ব্যাপারটা বিবেচনা করছি। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় কিন্তু তাদের বিবেচনা আর শেষ হয়না! এমনকি ক্লাব এর জেনারেল বডির মিটিং এ অনেক সাধারণ সভ্য এই বৈষম্যর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয়নি। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও ক্লাবের ৭৫ বছরের অনুষ্ঠানের সভায় চিত্রসাংবাদিকদের ক্লাবের সাধারণ সভ্যপদ দেওয়ার কথা বলেছেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারিকে অনুরোধ করেছিলেন। আমাদের সবার মনে খুব আনন্দ হয়েছিল। ভরসা ছিল স্নেহাশীস ও কিংশুকের উপর, যারা আমাদের সময়ের সাংবাদিক । একসাথেই ওঠা বসা।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অবস্থা পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতির পরও ক্লাব কর্তাদের আগের অবস্থান বদলায়নি! এটা নিয়ে কথা হলেই ক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর ও সম্পাদক কিংশুক প্রামাণিক বলেন – আমরা এব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবো।তোমাদের জন্য একটা কমিটি করে দিয়েছি। তারা রিপোর্ট দেবে। হয়ে যাবে এতো ভাবছো কেনো। মাসে নিয়মিত দেখাও করি। তারাও না বলেনি। আমরা জানি কমিটি করে দেওয়ার মানে। কোনো সদিচ্ছা থাকলে আমরা এতদিন রেগুলার মেম্বার হয়ে যেতাম। অধিকার বলে বলে হয়না, কেড়ে নিতে হয়। এ কথা আমরা সবাই জানি। আসলে আমরাও কমিটির মুখে NO কথাটা শুনতে চাই।
এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি! যে সাংবাদিকরা জীবনের সব জায়গায় বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব, তাদের ক্লাবেই চিত্রসাংবাদিকরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে রয়েছেন! পেশাগত দায়িত্ব পালন করার সময় লেখনী সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিক পাশাপাশি কাজ করেন। বস্তুত তারা একে অপরের পরিপূরক। সব খবরের কাগজ, পোর্টাল, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় একই ছবি। ক্যামেরা ও কলম বা বুম একসঙ্গে না চললে খবর হয়না। কিন্তু ক্লাবের ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা! কলকাতা প্রেস ক্লাবের বহু সাংবাদিক এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন। প্রতিবাদ জানিয়েছেন সারা ভারতের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রেস ক্লাব কর্তৃপক্ষ, যেখানে সবাই রেগুলার মেম্বার ভোটাধিকার আছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। সরকার বদলায়, শাসক বদলায়, দলবদলুরা দল বদলায়, সংবিধান বদলায় শুধু সিদ্ধান্ত বদলায় না লেখনী সাংবাদিকদের যাদের আমরা বা আপনারা রিপোর্টার বলি।
বঞ্চিত হতে হতে আমরা তাই ফুটপাথেই নেমে এসেছি। এটাই হয়ে উঠেছে আমাদের দেবী সরস্বতীকে আরাধনার জায়গা। অনেক অপমান, দুঃখ ও যন্ত্রণা বুকে নিয়ে এভাবে পুজো করতে হচ্ছে আমাদের। যদিও আমি ব্যাক্তিগত ভাবে এই পুজো করার বিরুদ্ধে। কিন্তু এটা মানতেই হবে যে পুজোটা ফটোগ্রাফাররা ফুটপাথেই করছে। এই সময়ের বহু চিত্র সাংবাদিক কিছু পুরোনোরাও আছে নিজেরাই চাঁদা দিয়ে পুজো করছে।
কলকাতার চিত্রসাংবাদিকরা শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চলেছেন। ভারতের সাংবাদিকতার ইতিহাসেও আমাদের কৃতিত্ব জায়গা পেয়েছে। শুধু ক্লাবের কর্তাদের চোখে আমরা অচ্ছ্যুৎ হয়ে রইলাম! ওরা আমরা হয়ে আজ তাই ফুটপাথই আমাদের উপযুক্ত জায়গা।