দেশের সময়: অন্য চোখটা তখনও চঞ্চল, দীপ্ত দৃষ্টিতে প্রবল অস্তিত্বের তেজ৷
তিনি বিনয় মজুমদার৷
পঞ্চাশের দশকের প্রখ্যাত কবি ৷ চরম দারিদ্র ও অবহেলায় অর্ধেক জীবন কাটনোর পর শেষ বেলায় পেয়েছিলেন আকাডেমী পুরস্কার ৷ কবি প্রতিভার স্বীকৃতিতে বিনয় ৷
কিন্তু তখনও তাঁর দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল যে অনেক লেখা বাকী ৷
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪পরগনার সীমান্ত শহর বনগাঁর অদূরে গাইঘাটার ঠাকুরনগরের শিমুলপুরে বিনোদিনী কুঠীরে কাটিয়েছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সেই বাড়িতে আজ তাঁর ৮৭তম জন্মদিন পালিত হল৷ কবিকে উৎসর্গ করেই দেশের সময় -এর নিবেদন ” তথ্য চিএ- স্মৃতিমেদুর বিনয়” প্রকাশিত হল এদিন ৷ দেখুন ভিডিও:
সাক্ষাতকার দিয়েছেন কবি সুবোধ সরকার , বিভাস রায় চৌধুরী , মলয় গোস্বামী, লালমোহন বিশ্বাস, প্রখ্যাত চিত্র সাংবাদিক আশোক মজুমদার , চিত্র শিল্পী মোহিনী বিশ্বাস এবং সমাজ সেবী ডাঃ সজল বিশ্বাস ৷
উপেক্ষিত হয়েই কাটিয়ে গেছেন সারাটা জীবন। যে কবির কলম জ্বলন্ত বিপ্লব, আজকের আধুনিক কবিতার যিনি পথপ্রদর্শক তাঁর যোগ্য সন্মান তিনি পেলেন কী ? এ প্রশ্নের গুঞ্জন আজও ভেসে বেড়ায় বাতাসে৷
কেউ বুঝলেন না তাঁর হৃদয় কোন অনির্বাণ আঘাতে বেদনায় জ্বলে উঠে অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ল। তাঁকে নিতান্তই শিশু ভেবে সীমানা প্রান্তে অগোচরেই রেখে দেওয়া হল। সেই কবি নিতান্তই অনারম্বর জীর্ণ জীবন কাটালেন প্রদীপের নীচের অন্ধকারে শহুরে আলোর চমকের বাইরে।
যিনি আমৃত্যু বিশ্বাস করে এসেছেন কলমের শক্তি তরোয়ালের থেকে বেশি। সেই নিভৃতে অন্তরালে থাকা মহাপ্রান হলেন আমাদের প্রানের কবি বিনয় মজুমদার। যিনি আজীবন তাঁর দুচোখের স্বপ্ন তে আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন।
তাঁর জন্ম ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সালে সুদূর বার্মা দেশের মিকাটিলা জেলার টোডো গ্রামে। বাবা বিপিনবিহারী মজুমদার, মা বিনোদিনী দেবী। ছয় ভাইবোনের তিনি সবার ছোট। বার্মা ছেড়ে বাংলাদেশ আসেন ১২ বছর বয়সে। ১৩ বছর বয়সে কবিতায় হাতে খড়ি ৷ তাঁর লেখা কবিতা পঞ্চাশ ষাটের দশকে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল ৷
১৯৪৮ সালে দেশ ভাগের সময় স্বপরিবারে ভারতের কলকাতায় চলে আসেন।
১৯৫৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন। ১৯৫৭ সালেই তিনি শিবপুর বি ই কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। এরপর শুরু ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মেকানিক্যাল বিভাগে পড়াশোনা ৷ কৃতী ছাত্র হিসাবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার ডাক পান ৷
জাপানও প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করার আমন্ত্রন জানায় ৷ কিন্তু না, বিদেশে চাকরির মোহে নিজের মাটি ছাড়েননি তিনি৷ ঠিক করে ফেলেন কবিতা সাধনা করেই জীবনটা কাটিয়ে দেবন৷ স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে গিয়ে জীবনে প্রচুর কষ্ট পেয়েছেন ৷ দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ৷ জীবন শায়ানে এসে সাহিত্য আকাডেমী পেয়েছিলেন হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ কাব্যগ্রন্থের জন্য ৷ স্বভাবতই খুশি।
১৯৫৮ সালে এনবিএ থেকে প্রকাশিত হয় আনুবাদ গ্রন্থ “অতীতের পৃথিবী”। সেই বছরই গ্রন্থজগৎ থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ “নক্ষত্রের আলোয়”।
তাঁর কর্মজীবনে কোথাও স্থায়ী হতে পারেননি। তাঁর প্রতিবাদী সত্ত্বা কবিতা কে মাধ্যম করে শক্তিশালী জোরালো আওয়াজ তোলে তাঁর গভির মনন। জীবন তাঁর কাছে সংগ্রাম, কবিতা গর্জে ওঠা প্রকাশের মাধ্যম। জীবনে প্রকৃতির নিয়মে আসে প্রেম, আবার হারিয়ে ফেলেন তাঁর ভাগ্যের পরিহাসে। সেই হাহাকার কখন আকুতি তে প্রকাশ হয়েছে “- ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,/ রথ হ’য়ে, জয় হ’য়ে, চিরন্তন কাব্য হ’য়ে, এসো।/ আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন/ সুর হ’য়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।“ অশ্লেশে আহ্বান জানিয়েছেন প্রেমিকাকে। আবার কখনও সুতীব্র হতাশা অবক্ত জন্ত্রনা ফুটে উঠেছে তাঁর কাব্যে “আর যদি নাই আসো, ফুটন্ত জলের নভোচারী/ বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো না –ইমেশো,/ সেও এক অভিজ্ঞতা ;অগণন কুসুমের দেশে / নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের আভাবের মতো…”
১৯৪৭ সাল থেকে বেছে নেন স্বেচ্ছা নির্বাসন। সীমান্ত শহর বনগাঁর অদূরে গাইঘাটার ঠাকুরনগরের শিমুলপুরে বিনোদিনী কুঠীরে থাকতেন। যা আজও জরাজীর্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে৷
অসামান্য মেধাবী, তুখোড় গণিতজ্ঞ। জটিল সমস্যার সমাধানে যার ছিল আনায়াস বিচরণ তিনি বাকি জীবন স্নায়ু রোগে আক্রান্ত হয়ে আট বার মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হন, একত্রিশবার দিতে হয়েছিল ইলেকট্রিক শক। এই রোগের প্রভাবে তাঁর হাত দুটি ক্রমাগত কাঁপত।
কবির “ফিরে এসো চাকা” অসুস্থতা ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ যাতে সাতাত্তরটি কবিতা ছিল গায়েত্রি চক্রবর্তী কে উৎস্বর্গ করে লেখা বলে কথিত আছে, যার সাথে কবির সেভাবে পরিচয়ই হয়নি, এক বার মাত্র সৌজন্য স্বাক্ষাত হয়েছিল কবি সে কথা নিজেই জানিয়েছিলেন।
কোন এক সময় কলকাতাতে থাকার জন্য মরিয়া ছিলেন সেই কবিই সব খ্যাতির ছটা বিনা দ্বিধায় ত্যাগ করে গ্রহন করলেন ঠাকুরনগরে স্বেচ্ছায় নির্বাসন। নির্জন প্রকৃতির কোলে দেখতেন পুষ্করিণীতে মাছের খেলা, দেখতেন কেমন জোড়ায় জোড়ায় শালিক নিজেদের মধ্যে মগ্ন। রং চটা পলেস্তরা খসা ঘরে বসে একাকী পূর্ণীমা রাতে জানলা দিয়ে দেখতেন চাঁদ। দেখতেন ঘোর অমাবশ্যার অন্ধকারে জোনাকির আলো । রাতের তারাদের সঙ্গে কথা বলতেন একান্তে ৷ সময় পেলে হারিকেন নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন গ্রামের ছেলে মেয়েদেরকে অঙ্ক শেখাতে ৷
তাঁকে নিয়ে কোন সংবাদ মাধ্যম উৎসাহ দেখিয়ে স্বক্ষাতকার নিতে গেলে তাদের তাড়িয়ে দিতেন, দরজা বন্ধ করে বসে থাকতেন, ছবি তুলতে দিতেন না৷ আবার কখনও নিজের প্রিয় কবিতা নিজেই পাঠ করতেন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁর ঘরেও কারও ঢোকার অনুমতি ছিল না শেষের দিকে, তাঁর মানসিক স্বাস্থ যে কোন পর্যায় পৌঁছেছিল তা সহজেই অনুমেয়।
বাংলা আধুনিক কবিতার পথপ্রদর্শক ছিলেন বিনয় মজুমদার। তাঁর হাত ধরেই আজকের বাংলা কবিতার চলন। তার কবিতায় ছিল কবি জীবনানন্দের ভাবধারা। অসাধারণ দক্ষতায় তিনি বাংলা ভাষা তথা কবিতা কে করেছেন সমৃদ্ধ।
কিন্তু বেক্তি বিনয় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলেন কই সমসাময়িক সাহিত্যের জ্যোতিষ্ক হয়ে! তাঁর যোগ্যতার প্রাপ্য মুল্যয়ন হল না। তাঁর ভাগ্য, জীবনধারা, তার নিতান্ত সাদামাটা দিনযাপন, নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে নেওয়া বুমেরাং হয়ে ফিরে এলো তাঁর সারা জীবনে।
তার কবিতা লেখা থেকে সরে আসা, দীর্ঘদিন পর মানসিক হাসপাতালে বসে ছাড়া পাওয়ার শর্তে কবিতা লেখা, পরিচিত, পরিবার থেকে সরে আসা এক অসামান্য প্রতিভা কে সারা জীবনের জন্য । কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে করে দিলো তাঁর প্রাপ্তি কে। দুঃখ, বিরহ, জন্ত্রনা, ব্যর্থতা সবটাই তিনি নীলকণ্ঠ হয়ে নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন।
শত জীর্ণ ময়লা লুঙ্গি আর হাফ ফতুয়ায় অশক্ত শরীরে গিয়ে বসতেন ঠাকুরনগর রেল ষ্টেশনের একটি বুকস্টলের পাশে এটাই ছিল তাঁর প্রিয় জায়গা । চা আর মাত্রাতিরিক্ত ধূমপান ছিল সঙ্গি। তিনি তাঁর সমসাময়িক লেখক কবিদের সঙ্গে এখানেই দীর্ঘ সময় কাটিয়ে গেছেন।
অন্যান্য কবি লেখকদের থেকে প্রতিভায় স্বতন্ত্র হয়েও নিজের আন্তরালেকেই স্বাছন্দ মনে করেছিলেন তিনি।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ২০০৫ সালে পেয়েছিলেন দুটি সন্মননা জাতীয় পুরস্কার সাহিত্য আকাদেমি, ও রাজ্যের তরফ থেকে রবীন্দ্র পুরস্কার। কিন্তু দুরভাগ্য তাঁর পিছু ছাড়ল না। চুরি গেল তাঁর স্বীকৃতি পুরষ্কার জা আজও পাওয়া জায়নি।
সাহিত্য চর্চার সঙ্গে টাকা রোজগারের সমীকরণকে গোলালনি বলে ঘরে চাপ চাপ অন্ধকার ৷ কারও সাহায্য মেলেনি ৷ তবুও লিখে গিয়েছেন কবিতাগুচ্ছ ৷
বঙ্গ তথা দেশের সবচেয়ে প্রতিভাবান কবির ম্রিত্তু হল ২০০৬ সালের ১১ই ডিসেম্বর। তাতেও পেলেন না তাঁর শ্রদ্ধা। তাঁর বাড়ির উঠানেই বানানো হয়েছে স্মৃতি সমাধি কিন্তু তা চরম আবহেলিত।ঠাকুরনগর প্লাটফর্মের ওপর তাঁর একটি মূর্তি বসেছে শিবেন, আশিষ, রমেনদের মতো হাতে গোনা দু’এক জন তাঁর অনুগামীদের সুবাদে ওই টুকুই। ।
সংরক্ষণ করা হয়নি তাঁর বাড়িটিও। ফাটল ধরেছে দেওয়ালে, সারা বাড়িতে গাছের পাতা ধুলো, ভাঙ্গা জীর্ণ আসবাবপত্র। বাড়ির একদিকে শুধু পাঁচিল দিয়ে গেট বসানো। তারই মধ্যে তাঁর নামাঙ্কিত একটি পাঠাগার শুধু তাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছে। সব প্রজন্মের কাছে তাঁর সৃষ্টি তুলে ধরাটাই এখন মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ সাহিত্যানুরাগীদের কাছে।
বিনোদিনী কুঠীরে গেলে আজও মনে হয় যেন কবি তাঁর নিজের সংকল্পে স্থির ৷ তবে শেষ বয়সে তাঁকে একাকিত্ব তাড়া করে বেড়িয়েছে ৷ কাগজের কোনে লিখে ছিলেন একান্ত মনের কথা ৷ যা আজও কান পাতলে শোনা যায় বিনোদিনী কুঠীরে ।