দেশের সময়: ১৯৪২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি , ইথার তরঙ্গে বহুদূর থেকে ভেসে এসেছিল সেই জলদগম্ভীর কন্ঠ,তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। নেতাজি সুভাষের অন্তর্ধান নিয়ে ভারত উত্তাল। ব্রিটিশরা আতঙ্কে ভুগছে। তারই মধ্যে ইথার তরঙ্গে শোনা গেল …

দিস ইজ সুভাষ চন্দ্র বোস স্পিকিং ইউ ওভার আজাদ হিন্দ রেডিও।”

চমকে উঠেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন।তারা বুঝতে পেরেছিল, নেতাজি সুভাষ শুরু করলেন নতুন যুদ্ধ। যে যুদ্ধে তাদের পরাজয় অনিবার্য। কারণ, ব্রিটিশরা জানত, ঝিমিয়ে পড়া জাতি ও আন্দোলনকে বল্গাহীন ঘোড়ার মত ছুটিয়ে দিতে তাঁর সমকক্ষ নেতা আর কেউ নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র শক্তি ও অক্ষ শক্তি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে থাকা নিজেদের রেডিও স্টেশনগুলির মাধ্যমে একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছিল এবং নিজেদের সৈন্যদের উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছিল। মিত্রপক্ষে থাকা ব্রিটিশরা তাদের নিজস্ব রেডিও স্টেশনগুলি ও অল ইন্ডিয়া রেডিওর মাধ্যমে ভারতবাসীদের মন পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নেতাজি তা হতে দেবেন না। কৌশল পাল্টে নিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে জার্মানরা ভারত নিয়ে ততটা উৎসাহী ছিল না। কারণ ভারত ছিল ব্রিটিশের অধীন। কিন্তু নেতাজি সুভাষ জার্মানিকে বুঝিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনকে উপড়ে ফেলতে হলে কেন ভারতে অক্ষশক্তির লাগাতার প্রচার চালানো দরকার। নেতাজি সুভাষের মূল লক্ষ কিন্তু ছিল জার্মানির পরিকাঠামো কাজে লাগিয়ে ভারতবাসীর কাছে নিজের রণকৌশল পৌঁছে দেওয়া। তাই, ১৯৪২ সালের ৭ জানুয়ারি, নেতাজি সুভাষ বার্লিন থেকে শুরু করেছিলেন আজাদ হিন্দ রেডিও বা ফ্রি ইন্ডিয়া রেডিওর সম্প্রচার।

“অনান্য জাতির কাছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ একদিনের শত্রু হলেও ভারতের কাছে সে চিরশত্রু”….. যতক্ষণ না পর্যন্ত ভারত নিজের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলবে।…আমাদের কমন এনিমিকে ( ব্রিটিশ) সরাতে যারা সাহায্য করবে আমরা তাদের আন্তরিকভাবেই সাহায্য করব। ভারতের উদ্ধার আমাদেরই হাতে।”
আজাদ হিন্দ রেডিওতে নেতাজি সুভাষের সেই ভাষণ সম্প্রচারের পর হিটলারের প্রচার সচিব জোসেফ গোয়েবল লিখেছিলেন,” ভারতের হয়ে আমাদের লড়াই আমরা এখন সরকারিভাবে শুরু করলাম।” পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত বেতারকেন্দ্রগুলি থেকে সম্প্রচারিত হতে লাগল নেতাজি সুভাষের ভাষণ।গর্জে উঠল সমস্ত দেশগুলি এই বাংলা মায়ের দামাল ছেলে নেতাজি সুভাষের সেই তেজোদ্দীপক দীর্ঘ ভাষণে।

আজাদ হিন্দ রেডিওতে দেওয়া নেতাজির ভাষণ ক্রমশ সুর্যের মতো উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছিল। যার হলকায় পুড়তে শুরু করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। হারতে শুরু করেছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে।মিথ্যা ও বিকৃত খবর প্রচারের জন্য আজাদ হিন্দ রেডিওতে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনকে (BBC) নেতাজি দিয়েছিলেন নতুন নাম, Bluff and Bluster Corporation। অল ইন্ডিয়া রেডিওকে (AIR) বলেছিলেন Anti-Indian Radio

আজাদ হিন্দ রেডিওতে নেতাজি সুভাষ ভাষণ শুরু করতেন ‘কমরেড’ শব্দটি দিয়ে। ভাষণ শেষ করতেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ‘আজাদ হিন্দ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে। আজাদ হিন্দ রেডিওতে বার্লিন থেকে সম্প্রচারিত হয়েছিল NO ENEMY OUTSIDE INDIA’S FRONTIERS (১৩ মার্চ,১৯৪২), THE CRIPPS MISSION( ২৫ মার্চ,১৯৪২) OPEN LETTER TO CRIPPS(৩১ মার্চ,১৯৪২) THANK YOU JAPAN (৬ এপ্রিল,১৯৪২) INDIA HAS BUT ONE ENEMY( ২০ এপ্রিল,১৯৪২) JAPAN HAS NO DESIGNS ON INDIA, DENY ALL HELP TO BRITAIN, THE AXIS POWER AND INDIA (১ মে, ১৯৪২), OUTSIDE HELP FOR FREEDOM FIGHT(১ মার্চ ,১৯৪৩) শীর্ষক ভাষণগুলি।

৩১ আগস্ট, ১৯৪২ সালে আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে সম্প্রচারিত THE ‘QUIT’ INDIA MOVEMENT শীর্ষক শিহরণ জাগানো ভাষণে তিনি ভারতের আবালবৃদ্ধবনিতা জানিয়েছিলেন কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে। ভারতবাসীরা সেদিন বুঝতে পেরেছিল, ব্রিটিশ কৌশল এবার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করার সময় এসেছে। ব্রিটিশ প্রশাসনকে সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্থ করে দেওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন নেতাজি, উচ্চকন্ঠে ভারতবাসীকে ‘Now or Never’ এবং ‘Victory or Death স্লোগানে দেশ কাঁপিয়ে দিতে বলেছিলেন।


আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে ইংরেজি, হিন্দি, তামিল, বাংলা, মারাঠি, পাঞ্জাবি, পুশতু ও উর্দুতে সাপ্তাহিক নিউজ বুলেটিন প্রচার করা হত। আজাদ হিন্দ রেডিও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সেরা সেরা স্বেচ্ছাসেবীরা। পরবর্তীকালে প্রথমে সিঙ্গাপুর, পরে রেঙ্গুনে আজাদ হিন্দ রেডিওর সদর দফতর স্থানান্তরিত হয়, কারণ নেতাজি যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি আঁচ করে চলে গিয়েছিলেন দক্ষিণ এশিয়ায়। তবে সদর দফতর স্থানান্তরিত হলেও বার্লিন থেকে আজাদ হিন্দ রেডিওর সম্প্রচার চালু থাকে নেতাজীর বিশ্বস্ত সঙ্গী এ সিএন নাম্বিয়ারের নেতৃত্বে।

আজাদ হিন্দ রেডিওতে ব্রিটেন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন নেতাজি। উদাত্ত কন্ঠে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানিয়েছিলেন। দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ব্রিটিশ সিংহ পিছু হঠতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছিলেন, আগামী দিনগুলিতে দেশবাসীকে সমস্ত রকম যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য তৈরি থাকতে হবে। কারণ ভারত ছেড়ে পালাবার আগে শত্রু তাদের নৃশংসতম আঘাতগুলি হানবে।

ভারতবাসীকে কোনও দিন মিথ্যা স্বপ্ন না দেখিয়ে বরং স্বাধীনতার বিজয় পতাকা গেঁথে গিয়েছিলেন অমর দেশনায়ক। ভারতের আকাশে জমে থাকা পরাধীনতার মেঘের ফাঁক দিয়ে নতুন মুক্তিসূর্য ওঠার খবর ভারতের আকাশে ছড়িয়ে দিয়েছিল আজাদ হিন্দ রেডিও , “রাতের সবচেয়ে অন্ধকার অংশটি থাকে সূর্যোদয়ের আগে। তাই সাহসী হও। সংগ্রাম চালিয়ে যাও। স্বাধীনতা হাতের মুঠোয় প্রায়। “ (তথ্য সংগৃহীত)৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here