(Timuli) পার্ক ও সবুজ টুম্ব  
 সাউথ কোরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ঐতিহাসিক শহর গিওংজু(Gyeongju) বা কিওংজু অবস্থিত। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ থেকে ৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ অবধি এই শহর শিলা(Silla) সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি অবধি প্রায় একহাজার বছর ধরে শিলা রাজারা কোরিয়ান উপদ্বীপের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল শাসন করেছিলেন।

এই সময়কালের প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ এই শহরে পাওয়া গেছে। তাই গিওংজুকে “দেয়ালহীন জাদুঘর” হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এখানকার ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্যের মধ্যে সেকগ্রাম গ্রোটো, বুলগুকসা মন্দির, গিওংজু ঐতিহাসিক অঞ্চল এবং ইয়াংডং ফোক ভিলেজ ইউনেস্কোর ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান হিসাবে মান্যতা পেয়েছে এবং গিওংজু শহর দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

কোরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বুসান থেকে গিওংজুর দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার। প্রতি ঘণ্টাতে বাস ছাড়ছে। এছাড়া ট্রেনও পাওয়া যায়। বুসান থেকে আমরা গিয়ংজু যাওয়ার বাস ধরলাম। দুই ঘণ্টাতেই এই ঐতিহাসিক শহরে পৌঁছে গেলাম। শহরে ঢোকার মুখে  অতি সুন্দর ও ঐতিহ্যবাহী প্রবেশ-দ্বার দেখেই বুঝলাম এই শহর অনেক ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। হাইরাইজ বিহীন ছিমছাম শহরটির চারিদিকেই সবুজ ঘাসে ঢাকা ছোট ছোট ঢিবি। এগুলি সামান্য তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা রয়েছে। ‘ডোন্ট টাচ’, ‘ডোন্ট ক্রস দা ফেন্স’ লেখা বোর্ড কোথাও চোখে পড়বে না। পাহারাদারও নজরে পড়ে না। নিজেদের ঐতিহ্যের প্রতি অতি শ্রদ্ধাশীল কোরিয়ানরা ইতিহাসের এইসব অমূল্য নিদর্শনকে অক্ষুন্ন রাখতে বদ্ধপরিকর। তাই যেখানে সেখানে গান বাজিয়ে পিকনিক করার ছবি চোখে পড়ে না।

আজ তিমুলি পার্ক, আনপজি পন্ড (Anapji pond) আর চেমসিয়ংডে(Cheomseongdae) অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবসরভেটিরি  সম্বন্ধে বলবো। শহরের নানা জায়গাতে সবুজ গোলাকার টুম্ব বা সমাধি চোখে পড়লেও রাজারাণীদের উল্লেখযোগ্য সমাধিগুলি  তিমুলি উদ্যানেই অবস্থিত। পিরামিড দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাই অনেকদিন থেকেই এই সমাধি ক্ষেত্র দেখার আগ্রহ অনুভব করছিলাম। উদ্যানে  সবুজের সমারহ দেখে মন ভরে গেল। এ যেন এক কল্প জগৎ। ছোট বড় অসংখ্য সবুজ ঢিবি। তিমুলি পার্কে ২০০ রও বেশি রাজকীয় সমাধি রয়েছে। এই স্মৃতিসৌধগুলি কোরিয়ার বৌদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষ আর্কিটেকচারের ব্যতিক্রমী ও তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহ্যের নিদর্শন। গিয়ংজু এবং এর আশেপাশের স্থান এবং স্মৃতিসৌধগুলি এদের সাংস্কৃতিক কৃতিত্বের অসাধারণ সাক্ষ্য বহন করছে।

প্রতিটি ঢিবির ভেতরেই কোন না কোন রাজা বা রাণীর দেহাবশেষ মাটির, কাঠের বা ধাতুর আধারে রাখা আছে। সঙ্গে সোনা রুপোর অসংখ্য সম্ভার। ১৯৭৩ সালে এখানে একটি সমাধি  স্তূপ খনন করা হয়। এই সমাধির নাম রাখা হয়েছে চিয়ংমাচং (Cheonmachong)অর্থাৎ ‘স্বর্গীয় ঘোড়া'(Heavenly Horse)। এই স্তূপে প্রাপ্ত একটি ঘোড়ার চিত্রের নাম অনুসারে এই নামকরণ। ঘোড়ার চিত্রটি কোরিয়ায় পাওয়া প্রথম প্রাক শিলা-রাজবংশের সময়কালের চিত্র। কীভাবে এই গোলাকার সমাধি ক্ষেত্র নির্মিত হয়েছিল এবং কিভাবে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী গুলি সাজানো হয়েছিল তা এই স্মৃতি-সৌধটি দেখলে বোঝা যায়।

এটিই একমাত্র স্মৃতি-সৌধ যা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। ১৫৭ মিটার পরিধি যুক্ত ও প্রায় ১৩ মিটার উচ্চতার এই সমাধিটিতে একটি কাঠের আধারে দেহাবশেষ রাখা আছে। আধারের পাশে সমস্ত মূল্যবান সামগ্রী রেখে পাথর ও মাটি দিয়ে ভরাট করে সমাধির এই গোলাকার রূপ দেওয়া হতো। এই টুম্ব থেকে এগারো হাজারেরও বেশী মূল্যবান গহনা, মুকুট এবং নানান সামগ্রী খনন করে উদ্ধার করা হয়েছিল। গিওংজুর জাতীয় জাদুঘরে এখানকার বেশীর ভাগ সামগ্রী রাখা আছে।

হাজার বছরের পুরানো সমাধি ক্ষেত্রতে দাঁড়িয়ে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি হচ্ছে। কোলাহল ও ঠেলাঠেলি ছাড়া লাইন দিয়ে খুব ভালো ভাবে ওখানে রাখা সব সামগ্রী দেখলাম। সমাধির অভ্যন্তরের আলোছায়া থেকে বাইরে বেরোতেই সামনে ঘন নীল আকাশের ব্যাকগ্রউন্ডে সবুজ স্তূপের অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ। একটু দূরেই রাজা-রাণীর জোড়া লাগানো টুম্ব দুটি দেখেও খুব ভালোলাগলো। রাজা সোজি এবং তাঁর স্ত্রীকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এখানে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো রাণীর সমাধিটি রাজার সমাধি থেকে বৃহত্তর। সবুজ ঢিবির এই আশ্চর্য পার্কে আরো অনেকক্ষণ থাকার ইচ্ছা থাকলেও বেরিয়ে আসতে হলো।
 সূর্য ঢলে পড়েছে।

এবার যাবো আনপজি পন্ড(Anapji pond) দেখতে। এখানে সূর্যাস্তের পর ব্লু আওয়ারে জলাশয়ে প্যালেসের প্রতিবিম্ব খুবই আকর্ষণীয় দৃশ্য। অনেক হাঁটাহাঁটি করে খিদে পেয়ে গেছে। রাস্তাতেই নানান খাবারের দোকান। কিন্তু অজানা খাবার খাওয়া খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে এখন সাবধান হয়ে গেছি। এই সুন্দর দেশে একটাই মারাত্মক সমস্যা, তা হলো ভাষা সমস্যা। একবার এক দোকানদারকে বারবার জিজ্ঞাসা করে বাদাম সেদ্ধ ভেবে সিল্ক ওয়ার্ম সেদ্ধ খেয়ে ফেলেছিলাম। খেতে খারাপ লাগেনি।

তবে অনেকদিন পরে সত্যিটা জানতে পেরে আমার মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিল। আনপজি জলাধারে যে রাজপ্রসাদের প্রতিবিম্ব দেখতে অসংখ্য দর্শক ভিড় জমান তার নাম  ডংগাঙ (Donggung) প্যালেস। শিলা রাজত্বকালে এটি তৈরী হয়েছিল। প্যালেসের প্রাঙ্গনে ৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে শিলা রাজা মুনমু(Munmu)র আদেশে জলাধারটি খনন করা হয়। এই জলাধার থেকে তেত্রিশ হাজার প্রত্নতাত্বিক সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে। জলাধারে প্যালেসের প্রতিবিম্ব সত্যিই খুব সুন্দর।

এবার চেমসিয়ংডে (Cheomseongdae) অবজারভেটরি টাওয়ার দেখতে যাবো। ছোট শহরটির দর্শনীয় স্থানগুলি পায়ে হেঁটেই দেখে নেওয়া যায়। এই টাওয়ারটি খুব বড়সড়ো না হলেও এটি পূর্ব এশিয়ার প্রাচীনতম ও এখনো বিদ্যমান জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ স্তম্ভগুলির একটি। যদিও এর ইতিহাস কিছুটা অস্পষ্ট, তবুও প্রাচীন কোরিয়ার বৈজ্ঞানিক গবেষণার ঐতিহ্যের প্রতীক হিসাবে টাওয়ারটি গণ্য হয়। ১৩০০ বছরের পুরানো স্তম্ভটি বারোটি লেয়ারে তৈরী, যা বারো মাসের হিসাব দেয়। আবার এর ৩৬৫ টি পাথর তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের ইঙ্গিতবাহী। রাতের আলোতে এই স্তম্ভের অজানা ইতিহাস আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

কালকে যাবো শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গিওংজুর প্রধান আকর্ষণ বুলগুকসা (Bulguksa) টেম্পেল দেখতে। এটি দেড় হাজার বছরের পুরানো। এই মন্দিরের গল্প আর একদিন বলবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here