পৃথিবী আজ এক ভয়ংকর সমস্যার মুখোমুখি। করোনা আতঙ্ক কাটিয়ে আবার কবে সব স্বাভাবিক হবে কেউ জানে না। এর মধ্যেই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানোর জন্য চীন উঠেপড়ে লেগেছে। লাদাখের দরজা পর্যটক দের জন্য আপাতত বন্ধ হয়ে গেছে ।
২০১৮ তে লাদাখ যাওয়ার সুযোগ ঘট২০১৮ তে লাদাখ যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিলো। সেই অসাধারণ, অপুরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পুরোপুরি কোনো ক্যামেরাতে ধরা বা লেখাতে প্রকাশ করা সম্ভব না। সেই অনন্য নীল পাঙ্গং (Pangong) লেক দেখার সৌভাগ্য কি আর আমাদের হবে! ভ্রমণ পিপাসু বন্ধু দের আমি আজ রূপসু ভ্যালি( Rupshu valley ) ও কায়াগার সো (Kiagar Tso)লেকের গল্প শোনাবো। লেখা ও ছবি শেয়ার করলাম। Tso উচ্চারন ‘সো’, মানে হ্রদ। লেহ শহর থেকে এর দূরত্ব ১৭৬ কিলোমিটার ৷
প্রত্যেক আলকচিত্রীই লাদাখ ভ্রমনের স্বপ্ন দেখে। হঠাৎ ই একটি ফটোগ্রাফি গ্রূপের সঙ্গে লাদাখ ভ্রমনের সুযোগ এসে গেলো । আমি আর দ্বিরুক্তি না করে ওদের সঙ্গে রাওনা হলাম। একটি ছোট বাস ও একটা গাড়িতে আমাদের বারো জনের ভালভাবে জায়গা হয়ে গেছে। প্রত্যেকেরই জানালার ধার চাই। কারন যাত্রা পথের সৌন্দর্য ক্যামেরাতে ধরে রাখতে হবে। যেখানে সেখানে বাস দাঁড় করানো সম্ভব নয়। তাহলে গন্ত্যব্যে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। ঠিক সময়ে পৌঁছতে না পারলে আবার আলো চলে যাবে। একটি প্রবন্ধে সমগ্র লাদাখের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। সো মোরিরি (Tso Moriri) যাওয়া আসার পথেই রুপাসু উপত্যকা ও কায়গার সো লেক পড়বে। লেহে থেকে সকাল আটটাতে আমাদের যাত্রা শুরু হল। সদা হাস্যময় ড্রাইভার ইলিয়স খুবই ভালো গারী চালায়। আজ আমাদের সঙ্গি মেঘহীন ঝক ঝকে আকাশ। গাড় খয়ড়ী রঙের পাহাড়। আর সায়ক নদী। অর্থাৎ ওভার সাচুরেটেড ল্যান্ডস্কেপ। রোদে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। লাদাখে সানগ্লাস মাস্ট। পাহাড়ের গা বেয়ে নানা ধরনের পাথরের ধসে রাস্তা ভর্তি। তার ওপর দিয়েই ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বাস চলেছে। লাঞ্চের ডিমের অমলেট আর নুডুলস কখন হজম হয়ে গেছে। রাস্তার দুই দিকেই মারমট দের ছুটো ছুটি দেখতে পাচ্ছি।
এদের স্বাস্থ্য প্যাংগং(Pangong) লেকে যাওয়ার পথে দেখা মারমট(Marmot) দের মতন নয়। ওখানে দেখেছি কিছু মানুষ চিপস দিয়ে প্রাণীদের ছবি তুলছে। তাই অনেক প্রাণীর ই গায়ের লোম উঠে গেছে। এদের স্বাস্থ খুবই ভালো। মানে চিপস খাওয়ান পাবলিক রা এখানে কম আসে বোঝা যাচ্ছে। বাইক বাহিনির দাপট ও দেখছি না। রুক্ষ নিরেট পাহাড়ের ঘেরাটোপ থেকে হঠাৎ আমরা হলদেটে সবুজ এক মাল্ভূমিতে হাজির হলাম। সাতদিন ধরে আমাদের যাত্রা পথে এরকম দৃশ্য দেখিনি। এ যেন অন্য এক পৃথিবী। এটাই লাদাখের রূপসু(Rupshu) উপত্যাকা। এটি লাদাখের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত শুকনো, উচ্চ-উচ্চতার মালভূমি। এখানে যাযাবর জনজাতি ছাড়া অন্য কোনো জনবসতির চিহ্নমাত্র নেই। কিছুটা এগিয়ে এবার যাযাবর জাতির দেখা পেলাম। এই স্থান তিব্বতের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে এখানে যাযাবর প্রজাতিতে তিব্বতীয় জীবনযাত্রার ছাপ দেখা যায়।
নদীর আশে পাশে এরা পাথর দিয়ে খঁয়াড় বানিয়েছে ভেড়ার পাল রাখাবে বলে। নিজেদের জন্য তাঁবু খাটিয়েছে। বাচ্চারা খেলে বেড়াচ্ছে। এতো রিমট জায়গাতে এরা কি ভাবে জীবন ধারন করে ভেবে খুবই অবাক লাগলো। তীব্র শীতে নিশ্চয়ই নীচের দিকে নেমে যায়। এদের উপস্থিতির জন্যই রূপসুভ্যালি কে ‘ল্যান্ড অফ নোমাডিক’ বলা হয়। এখানের যাযাবর বাসিন্দা রা চ্যাংপা নামে অভিহিত, এরা ছাগল, ইয়াক, কুকুর এবং মেষ পালন করে। পশুর পাল কে সাথে নিয়েই এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা ভ্রমণ কর। এই ভাবেই তারা যাযাবর জীবন যাপন করে। এছাড়া লাদাখ, লাহুল এবং স্পিতির মধ্যে ক্যারাভান করে পণ্য পরিবহন করে তারা অতিরিক্ত টাকা উপার্জন করে থাকে। রূপসু অঞ্চলটি বন্য গাধা,ঘোড়া, মারমোট দের স্বাধীন বিচরণ ভূমি। কালো ঘাড়যুক্ত ক্রেন এবং গ্রিজ হাঁস গ্রীষ্মে প্রজননের জন্য হ্রদের ধারে জড়ো হয়। রূপসু ভ্যালি ট্রেক করার সেরা মরসুমটি জুন থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি। অক্টোবরের পরে, এটি শীতলতমো স্থানে পরিণত হয় এবং পুরো অঞ্চল জুড়ে তুষারপাত শুরু হয় যায়। ১৯৮৯ সালে এই উপত্যকা পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এখানেই কায়াগার সো লেক(Kiagar) । এটা একটি লবণ হ্রদ।
আমরা এখন লেকর কাছে পৌঁছে গেছি। আমাদের সামনে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য। জানি না কি ভাবে বর্ণনা করব। ছোট্ট লেকটার নীল রঙ আবার পাঙ্গং লেকের মতন নয়। আলাদা ধরনের গভীর নীল রং। সুলেখা কালির উদাহরণ মনে পড়ে গেলো। এই মুহূর্তে আমরা ছাড়া আর কোন টুরিস্ট নেই। নেটে রূপসু উপত্যকাকে অতি দুর্গম স্থান বলা হয়েছে। তাই বোধ হয় পর্যটকদের আনাগনাও কম। এই হ্রদ কে হয়তো অনেক পর্যটক উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে চলে যান। কারণ সোমোরি পৌঁছনোর তাড়া থাকে । যারা লাদাখ গেছেন কিন্তু এই লেকটি দেখেন নি, পরের বার এই পথে গেলে, এক মুহুর্তের জন্য থামুন এবং এই আশ্চর্যজনক সুন্দর ছোট হ্রদে কিছুটা সময় ব্যয় করে যান। ১৫৪০০ ফিট উচ্চতায় এই অসাধারন স্থানটি যেন আনটাচেবেল থেকে গেছে। দুটি চারটি বুনো ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে। অনেক দূরে দুইজন যাযাবর ছেলে ভেড়া চড়াচ্ছে। মন্ত্রমুগ্ধর মতন আমরা তাকিয়ে আছি। মেন্টররাও আমাদের তাড়া না দিয়ে ফটো তলাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের দলের সব থেকে উৎসাহী মারয়ারী ছেলেটির কথা না বললেই নয়। ডেফ অ্যান্ড ডাম সৌরভের প্যাশন কে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ও এত দূরে চলে যাচ্ছিলো, আর ডাকলেও শুনতে পাচ্ছে না। মন না চাইলেও এবার এগতে হবে।
ইচ্ছা করছে এখানেই তাঁবু খাঁটিয়ে থেকে যাই।প্রকৃতির কাছে সংসার শহুরে জীবন সবই যেন তুচ্ছ। অপার প্রকৃতি ও নির্জনতা মনকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সো মোরিরি পৌঁছতে হব। তাই মোহাবিষ্টের মতন বসে উঠলাম। বাস চলতে শুরু করলো মন পড়ে থাকলো কায়াগার সোর ঘন নীল জলরাশিতে, যাযাবর শিশু আর মারমট দের সাথে। ছবি- লেখক৷