রতন সিনহা,দেশের সময়, চীন: আজ আপনাদের নিয়ে আমরা বেড়াতে যাবো চীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর শাংহাইয়ে। শুরুতে শাংহাই সম্পর্কে আপনাদের একটা সাধারণ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো। তারপর আমরা আপনাদের শোনাবো শাংহাই ভ্রমণের গল্প। ও গল্পের মাধ্যমেই আপনাদের শাংহাই ভ্রমণ হয়ে যাবে আশা করি।
রাতের শাংহাই শহর- ছবি রতন সিনহা।
শাংহাই চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর। চীনের অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এ শহর। শাংহাইয়ের প্রতীক এর উঁচু উঁচু ভবন, সমৃদ্ধ সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা। শাংহাই চীনের প্রথম শহর যেটি বাইরের দুনিয়ার সাথে প্রথম বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। সেই শাংহাই আজ পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকিং ও বাণিজ্যিক শহর।
শাংহাই বৈচিত্র্যময়। এখানে ঐতিহ্যবাহী ছোট রাস্তা ও পুরাতন পশ্চিমা স্থাপত্যের নিদর্শন যেমন আছে, তেমনি আছে আধুনিক উঁচু উঁচু ভবন। এখানে আছে চীনা বৈশিষ্ট্যের নানা ধরনের পার্ক। পুরাতন ও নতুনের মিশেলে এ শহর সত্যিই নান্দনিক।
শাংহাইয়ে চারটি মৌসুম আছে। বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরত ও শীত। এ শহরে বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো সময় বসন্ত ও শরত্কাল। বসন্তকালে শতাধিক ধরনের ফুল ফোটে। উষ্ণ সুর্যালোকে শহরটির প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের শ্রেষ্ঠ সময়। আর শরত্কালে শহরের তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে। এ তাপমাত্রা ঘুরে বেড়ানোর জন্য উপযোগী।
শাংহাইয়ে অনেক দর্শনীয় স্থান আছে। এগুলোর বেশিরভাগই শহরের কেন্দ্র এবং ওয়াই থানের দু’তীরে অবস্থিত। ছেং হুয়াং মিয়াও, ইয়ু ইয়ান এবং নান চিন ওয়াকিং স্ট্রিটে একটি গোটা দিন কাটিয়ে দিতে পারেন। আরেকটি দিন ছি পাও পুরানো স্ট্রিট, সু চিয়া হুই ও চিং আন মন্দির ঘুরে দেখতে পারেন। তৃতীয় দিনে বেড়াতে যেতে পারেন সিন থিয়েন ডি শপিং মল, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সম্মেলনের পুরার্কীর্তি এবং থিয়েন চি ফাংসহ নানা দর্শনীয় স্থানে। হাতে যদি আরও সময় থাকে, তাহলে জাদুঘরে যেতে পারেন; করতে পারেন খানিকটা কেনাকাটা।
এ ছাড়া, শাংহাইয়ের ডিজনিল্যান্ড ও হুয়ানলেকুসহ নানা বিনোদন পার্ক শিশুদের বেড়ানোর শ্রেষ্ঠ জায়গা।
তো, মোটামুটি শাংহাই সম্পর্কে একটা ধারণা আপনারা পেলেন। এখন চলুন আমরা শাংহাইতে ঘুরে বেড়াই ছবির খোঁজে৷
ওরিয়েন্টাল টিভি টাওয়ার -ছবি রতন সিনহা।
দক্ষিণ থেকে উত্তর দিক পর্যন্ত ৮৮০ মিটার লম্বা। পূর্ব থেকে পশ্চিম দিক পর্যন্ত ৫০০ মিটার লম্বা। আয়তন ৪ লাখ ৪০ হাজার বর্গমিটার। ১০ লাখ মানুষের সমাবেশ করা যায় এই চত্বরে। বর্তমানে বিশ্বে বৃহত্তম শহর মহাচত্বর এটি।
১৯৪৯ সালের পয়লা অক্টোবর চীন গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। চেয়ারম্যান মাও থিয়ান আন মেন ভবনে দেশটির প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেন এবং নিজে প্রথম পঞ্চতারকাখচিত লাল পতাকা উত্তোলন করেন। তখন থেকে থিয়ান আন মেন ভবনটি নয়াচীনের প্রতীকে পরিণত হয়।
নয়াচীন প্রতিষ্ঠার পর থিয়ান আন মেন মহাচত্বর সম্প্রসারিত হয়েছে। মহাচত্বরের কেন্দ্রে গণবীরদের স্মরণে নির্মিত স্তম্ভ, মহাচত্বরের পশ্চিমে মহা গণভবন, পূর্ব দিকে চীনা বিপ্লব জাদুঘর ও চীনা ইতিহাস জাদুঘর এবং দক্ষিণ দিকে চেয়ারম্যান মাও মেমোরিয়াল হল। থিয়ান আন মেন মহাচত্বর অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী।
থিয়ান আন মেন মহাচত্বরের বিখ্যাত দৃশ্য হলো নিত্যদিনের পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান। এটা বেইজিং পৌর পর্যটন কমিটির নির্দিষ্ট পর্যটন প্রকল্প। পতাকা উত্তোলনের সময় সূর্য উদয় অনুযায়ী, সাধারণত সকাল ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত চলে।
কুংমিং এর স্টোন ফরেস্ট -ছবি রতন সিনহা।
চীনের শীর্ষ মেমোরিয়াল হল। সাধারণ আয়তন ২৮ হাজার বর্গমিটার। এখানে চেয়ারম্যান মাও’র মরদেহ সংরক্ষিত আছে। কাঁচের দেওয়াল দিয়ে ঢাকা মরদেহটি বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখানে আসেন, মাওয়ের মরদেহ প্রত্যক্ষ করেন এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। এখানে বহুসংখ্যক ছবি ও দলিলও সংরক্ষিত আছে।
চীনের জাতীয় গণকংগ্রেস সম্মেলন আয়োজনের স্থান। সিপিসি, দেশ ও বিভিন্ন গণ-গ্রুপের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের স্থান। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। চীনের নেতারা সাধারণত বিদেশি মেহমানদের সাথে এখানেই সাক্ষাত করেন। ভবনটি দক্ষিণ থেকে উত্তর দিক পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৩৩৬ মিটার, পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত ২০৬ মিটার। উচ্চতা ৪৬.৫ মিটার। আয়তন ১ লাখ ৫০ হাজার বর্গমিটার৷
চীনের মিং ও ছিং রাজবংশ আমলের রাজকীয় প্রাসাদ। আগের নাম ছিল নিষিদ্ধ পুরী বা নিষিদ্ধ নগরী। এটা চীনের প্রাচীনকালে প্রাসাদভবনের মূল অংশ। ৭ লাখ ২০ হাজার বর্গমিটার আয়তন। কভার্ড এলাকা দেড় লাখ বর্গমিটার। বড় ও ছোট সাইজের প্রাসাদ ৭০টির বেশি। ঘর ৯ হাজারের বেশি। বর্তমানে বিশ্বে কাঠের তৈরি বৃহত্তম স্থাপত্য। ১৪০৬ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৪২০ সালে সম্পন্ন হয়। দক্ষিণ থেকে উত্তর দিক পর্যন্ত ৯৬১ মিটার, পূর্ব থেকে পশ্চিম দিক পর্যন্ত ৭৫৩ মিটার। চারদিকে ১০ মিটার উঁচু দেয়াল আছে। বাইরে ৫২ মিটার প্রস্থ দুর্গপরিখা আছে। ফ্রান্সের ভার্সেই, ব্রিটেনের বাকিংহাম প্রাসাদ, যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস ও রাশিয়ার ক্রেমলিন ভবনের সাথে চীনের এই প্রাসাদের নামও উচ্চারিত হয়। এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলোর একটি। চীনের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি সংরক্ষণ ইউনিটও এটি এবং জাতীয় ৫-এ পযায়ের দর্শনীয় স্থান।
পিক সিজনে টিকিটের দাম ৬০ ইউয়ান এবং অফ সিজনে ৪০ ইউয়ান।
নিষিদ্ধনগরে অনেক বিরল পুরাকীর্তি সংরক্ষিত আছে। এগুলোর মধ্যে চিত্রকলা, হস্তলিপিশিল্প, চীনামাটি, তাম্রপাত্র, জেড, ঘন্টা ইত্যাদি নানান পুরাকীর্তি আছে ১০ লাখের বেশি।
চীনের বেইজিংএ বিখ্যাত প্রাচীর- রতনসিনহা
মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৬শ’ মিটার। বেইজিংয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যবসাসড়ক। এখানে রয়েছে চীনের বৃহত্তম চারু ও কারুশিল্প দোকান, চীনের বৃহত্তম সিনহুয়া বইয়ের দোকান ও বিদেশি ভাষা বইয়ের দোকান, চীনের বৃহত্তম স্টুডিও এবং মুসলিম বাণিজ্যভবন ইত্যাদি। এ ছাড়া, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যময় বিখ্যাত রেস্তোঁরা ও খাবার দোকানও আছে এই স্ট্রিটে।
ওয়াং ফু চিংয়ে বেইজিং ও চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের হালকা খাবার, স্মারকপণ্য, হস্তশিল্প ইত্যাদি পাওয়া যায়।
চীনের ছিং রাজবংশ আমলের রাজকীয় উদ্যান। বেইজিংয়ের পশ্চিমাংশে অবস্থিত। শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। সম্পূর্ণভাবে সংরক্ষিত একটি রাজকীয় প্রাসাদ এটি। একে “রাজকীয় উদ্যান জাদুঘর” বলে গণ্য করা হয়। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনস্থান। ১৯৬১ সালের ৩ মার্চ প্রথম দফা জাতীয় পুরাকীর্তি সংরক্ষণ ইউনিট নির্বাচিত হয়। ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে “বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায়” অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০০৭ সালের ৮ মে চীনের জাতীয় পর্যটন ব্যুরোর অনুমোদনে জাতীয় ৫-এ পর্যায়ের দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়। টিকিটের দাম পিক সিজনে ৩০ ইউয়ান এবং অফ পিক সিজনে ২০ ইউয়ান।
বেইজিংয়ের ফরবিডেন সিটি:
ফরবিডেন সিটি ছবি- রতন সিনহা ।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের কথা উল্লেখ করলে অনেকের মনে পড়বে মহাপ্রাচীরের কথা। আবার অনেকে ভাববেন নিষিদ্ধ নগর বা ফরবিডেন সিটির কথা।
হ্যাঁ, বেইজিংয়ের কেন্দ্রীয় অঞ্চল থিয়েনআনমেন মহাচত্ত্বরের ঠিক উত্তরে সুমহান প্রাচীন স্থাপত্যের সংগ্রহশালা আছে। বিশ্বখ্যাত নিষিদ্ধ নগর (ফরবিডন সিটি) বা রাজপ্রাসাদ জাদুঘর। বেইজিংয়ের রাজপ্রাসাদ জাদুঘর হলো চীনের প্রাচীন প্রাসাদ স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। উপরন্তু এটি বর্তমানে পৃথিবীর সংরক্ষিত সবচেয়ে বড় আকার, সম্পূর্ণ একটি প্রাচীন কাঠের তৈরি স্থাপত্য। ১৯৮৭ সালে নিষিদ্ধ নগরকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শুধু তাই নয়, ইউনেস্কো একে সংরক্ষিত প্রাচীন কাঠের কাঠামোর বৃহত্তম সংগ্রহ হিসাবে তালিকাভুক্ত করে।
তেননানমেন স্কয়ার ছবি রতন সিনহা
নিষিদ্ধ নগরী ছিল চীনের রাজপ্রাসাদ, যা মিং রাজবংশের আমলে তৈরি হয়। এটি চীনের বেইজিং শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। বর্তমানে এটি প্রাসাদ জাদুঘর। ১৫ বছর ধরে দশ লাখেরও বেশি শ্রমিক প্রাসাদ নির্মাণের কাজ করেন। নিষিদ্ধ নগরের আকার এতো বিশাল, শৈলী এতো সুন্দর, স্থাপত্য এত সুমহান এবং আসবাবপত্র এত বিলাসী যা পৃথিবীতে খুব কম দেখা যায়। এর আয়তন ৭ লাখ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি। উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ্য প্রায় এক হাজার মিটার, পূর্ব-পশ্চিম দিকে প্রস্থ প্রায় আটশ’ মিটার। চার দিকে দশ মিটারেরও বেশী উঁচু দেয়াল আছে। দেয়ালের বাইরে চারদিক ঘিরে ৫০ মিটার চওড়া আয়তাকার জলাধার রয়েছে। প্রায় ৫০০ বছর ধরে, এটি সম্রাট এবং তাদের পরিবারের পাশাপাশি চীন সরকারের আনুষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। সম্রাটের অনুমতি ছাড়া এ এলাকায় কেউ প্রবেশ করতে বা এলাকা ত্যাগ করতে পারতো না বলে এর নাম ফরবিডেন সিটি বা নিষিদ্ধ নগর হয়েছিলো। ইউয়ান রাজবংশের সময় এখানে প্রথম রাজকীয় নগর গড়ে ওঠে।
১৪০৬ থেকে ১৪২০ সালে তৈরি হয় এ স্থানটি। জটিল ভবনগুলো ৭,২০,০০০ বর্গ মিটার জুড়ে ৯৮০ ভবন নিয়ে গঠিত। রাজ প্রাসাদ হিসেবে নিষিদ্ধ নগরে অসংখ্য মূল্যবান পুরাকীর্তি সংরক্ষিত আছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এখানে ১০ লাখেরও বেশি মূল্যবান পুরাকীর্তি আছে। নিষিদ্ধ নগরে যে পরিমাণ পুরাকীর্তি সংরক্ষিত হয়েছে, তার পরিমাণ চীনের পুরাকীর্তির ছয় ভাগের এক ভাগ! এ সব পুরাকীর্তির মধ্যে অনেকগুলোই হলো অমূল্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ।
চীনের বিখ্যাত মেঘলেভ ট্রেন ,প্রতি ঘণ্টায় ৪৩১কিলো. মিটার ছুটছে৷ ছবি-রতন সিনহা।
দ্রুত গতির বুলেট ট্রেন ছবি রতন সিনহা৷
বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে চীন সরকার শতাধিক ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডার তৈরি করে। নিষিদ্ধ নগরের বেশিরভাগ পুরাকীর্তি এখন এসব ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডারে রাখা হয়েছে। রাজপ্রাসাদ ঐতিহ্যবাহী চীনা চমত্কার স্থাপত্যের দৃষ্টান্ত, যা বিশ্বজুড়ে সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যকে প্রভাবিত করেছে।
মেঘলেভ ট্রেন এর সাথে লেখক৷
ফরবিডেন সিটি এখন আর নিষিদ্ধ নয়। ফরবিডেন সিটি বা নিষিদ্ধ নগর এখন পর্যটকদের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত।
(দেশের সময়)