খুন, খুনের প্ররোচনা, চুরি কোন অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি তার বিরুদ্ধে। তবুও দেশের একশ্রেণীর মিডিয়াপণ্ডিত, বিভিন্ন চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়াতে খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে প্রায় দেড়মাস সময় জুড়ে চব্বিশ ঘন্টা অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল চালাচ্ছেন।

তাই বোধয় রিয়ার টি-শার্টে উঠে এল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সেখানে পিতৃতন্ত্র ধ্বংস করার ডাক দিয়েছেন তিনি। ইংরেজিতে লেখা সেই প্রতিবাদের বাংলা করলে যা দাঁড়ায় –”গোলাপ লাল, বেগুনি আসলে নীল, আসুন পিতৃতন্ত্র ধ্বংস করি।”

অবাক কান্ড হল এটাই যে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলিতে নয়, তাকে গ্রেপ্তার করা হল সম্পূর্ণ অন্য এক অভিযোগে। এমনিতে সুশান্তের মৃত্যু নিয়ে ইতিমধ্যেই এতরকম তত্ব আওড়ানো হয়েছে, যারমধ্যে রিয়ার গ্রেফতার ঠিক কিভাবে জড়িত তা আজব বটে।

ইনভেস্টিগেটিং জার্নালিজমের নামে একশ্রেণীর মিডিয়া অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত এর অস্বাভাবিক মৃত্যু সংক্রান্ত যে খবরগুলি পরিবেশন করছেন তা আষাঢ়ে গল্প, অশালীন কৌতূহল এবং অন্ধ বিদ্বেষের এক কদর্য মিক্স ছাড়া আর কিছুই নয়। এরমধ্যে উঁকি মারছে, মনুবাদী পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির মুখ। একজন অভিনেতার দুঃখজনক মৃত্যু হয়ে উঠেছে ভোট বৈতরণী পার হওয়ার পুঁজি। সুশান্তের মৃত্যুর তদন্ত হোক যদি কেউ অপরাধী প্রমাণিত হন, তার শাস্তি হোক, কিন্তু বিচারের নামে মিডিয়া ট্রায়ালের এই অনাচারের প্রতিবাদ হওয়া উচিৎ।

ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, দেশে যেন এর বাইরে আর কোন খবর নেই। একটা উদাহরণ দিলেই এই কুনাট্যের ব্যাপকতা বোঝা যাবে। এই সময়কালে অতিমারি করোনা তছনছ করে দিয়েছে পৃথিবী। প্রতিদিন বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি সবকিছু বিপর্যস্ত। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে উঠেছে এই কুনাট্য!

মৃত্যুর পর থেকে সাম্প্রতিক সময় অবধি সুশান্তকে নিয়ে ৬৬ হাজারেরও বেশি খবর মিডিয়াতে এসেছে। ডিজিটাল মিডিয়ায় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে প্রতিবেদনের সংখ্যা মাত্র ১০ হাজার। কৃষকদের নিয়ে প্রতিবেদনের সংখ্যা ৩৩৭১। প্রকৃত সংবাদকে ঢেকে দেওয়ার এ এক বিপজ্জনক প্রবণতা! অর্থনীতির ভয়াবহ অবস্থা; ট্রেন, এয়ারপোর্ট বেসরকারি হাতে চলে যাওয়া; হাজার হাজার মানুষের আত্মহত্যা সবকিছুই মিডিয়ার তথাকথিত বিশ্লেষক বা পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়। আমরা সবাই চাই সত্য সামনে আসুক, কিন্তু প্রকৃত সংবাদকে ঢেকে দিয়ে টিআরপি বাড়ানোর তাড়নায় মিডিয়া ট্রায়াল কোন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ চায় না।

বাড়ি ফিরে টিভি খুললে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলে মনে হয়, রাজনীতি খবরকে হাইজ্যাক করে নিয়ে পালিয়েছে। বিহার সংক্রান্ত খবরের দিকে তাকালে বিজেপির এই গেম প্ল্যানটা পরিষ্কার হয়। সেখানে ভোট আসছে। সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর দুঃখজনক ঘটনা সেখানে তাদের ভোটের হাতিয়ার।

অন্যদিকে আজ মুম্বাইয়ে কঙ্গনা রানাউতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্র সংক্রান্ত খবরের দিকে তাকালে কংগ্রেস, শিবসেনার জোট সরকারকে টাইট দেওয়ার জন্য বিজেপির অপচেষ্টার ছবিটা পরিস্কার ফুটে ওঠে।

আসলে এসব কিছু যেন চলছে একটা স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী। বিহারে নিতীশ সরকারের অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। আরও খারাপ অবস্থা বিজেপির। তাই এই খেলাটা চলছে রাজপুত ভোট ধরার জন্য। সুশান্ত সিং নামটির পিছনে ‘রাজপুত’ শব্দটার দিকে তাদের নজর। তারা একটি দুঃখজনক মৃত্যুকে নিয়ে স্রেফ ভোটের রাজনীতি শুরু করেছে রাজপুত ভোটের দখল নিতে।

একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, আমাদের সমাজে মেয়েদের দাম বরাবরই কম। জীবনভোর দেখে এলাম খারাপ কিছু ঘটলেই ‘কেষ্ট ব্যাটাই চোর’ এর মত সব দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় মেয়েদের ওপর। এই বিতর্কেও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা। ছেলেটির মৃত্যু দুঃখজনক হলেও তার কোনো দোষই মিডিয়া দেখতে নারাজ। যদি সুশান্তের বদলে রিয়ার সঙ্গে এই ঘটনা ঘটতো, তাহলে কি মিডিয়া ও তাদের অনুসরণকারী হুজুগে জনগণ একই প্রতিক্রিয়াশীল হতো? মনেহয় না। কারণ কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা কিংবা ফুটপাথে ঘুমন্ত পথচারীকে পিষে দেওয়া অথবা সরাসরি মুম্বাই বিস্ফোরণে জড়িত বলিউড হিরোগুলির কোর্ট ট্রায়ালের সময় দেখা গেছে মিডিয়া যেন কোনো ভারতরত্নের পিছনে দৌড়াচ্ছে। এই দ্বিচারিতা কেন ? তাই রিয়ার টি-শার্টের প্রতিবাদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, আমরা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই থাকতে চাই। নাহলে আমার বিশ্বাস দেশ গর্জে উঠতোই।

সবথেকে বেশি আশ্চর্য্য লাগছে, তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই যেন ধরে নেওয়া হচ্ছে অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর জন্য রিয়া চক্রবর্তী দায়ী। বলিউডে এর ড্রাগ র‍্যাকেটের ব্যাপারে বারবার নানারকম অভিযোগ উঠেছে। অনেক বিখ্যাত অভিনেতা, অভিনেত্রীদের নামও জড়িয়েছে এব্যাপারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তদন্ত মাঝপথে থমকে গেছে। মানুষ চায় এব্যাপারে বিস্তারিত তদন্ত হোক, দোষীরা শাস্তি পাক। কিন্তু তা না করে প্রথম থেকে রিয়াকে যেভাবে মাদক পাচারকারী বা মাদকাসক্ত বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে তা কি শুধুই তিনি বাঙালি মেয়ে বলে?

এককথায় যা চলছে তা একটা অর্গানাইজ ক্যাম্পেন। ব্যাপারটা প্রথমে বুঝতে না পারলেও এখন অনেকেই বিজেপির এই খেলাটা ধরতে পারছেন। শাবানা আজমি, বিদ্যা বালান, অনুরাগ কাশ্যপ, রাধিকা আপ্তে, দিয়া মির্জা, সোনম কাপুরের মত বলিউডের চেনামুখরা এই একপেশে মিডিয়া ট্রায়ালের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। একটু বোধবুদ্ধি যাদের আছে তারা সবাই একটি দুঃখজনক মৃত্যুর প্রকৃত তদন্ত চাইবেন। কিন্তু তদন্তের নামে উইচ হান্টিং নয়। সেই ঘটনাটাই কিন্তু ঘটছে। এতে রাজনীতি, সাংবাদিকতা, প্রশাসন ও পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। যারা এগুলো করছেন তারা ভুলে যাচ্ছেন প্রতিটি ক্রিয়ার একটা প্রতিক্রিয়া আছে। রিয়ার প্রতিবাদ আজ টি-শার্টে ভাষা পেয়েছে। মানুষের প্রতিবাদ কিন্তু এবার পথে নামবে। রাজনীতি আর সংবাদ ব্যবসায়ীদের পক্ষে সেটা কিন্তু খুব একটা ভালো সময় হবেনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here