পার্থ সারথি নন্দী: দুর্গাপুজো এলেই ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়েন এক ঝাঁক ছেলে-মেয়ে। শুধু ছবি তোলার নেশাতেই মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়ান তাঁরা। ভালো ছবি তোলার সুযোগ মিললেই দ্রুত ক্লিক হয় ক্যামেরার শাটারে। পুজোর আগে এই ছবিপ্রেমী ছেলে মেয়েদের ছবির খনি হয়ে ওঠে কলকাতার কুমোরটুলি সহ রাজ্যের বিভিন্ন পটুয়াপাড়া।
কোলকাতা শোভাবাজারের রবীন্দ্র সরণির বিখ্যাত কুমোরটুলির মতোই উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর শিমুলতলা তালতলার অলিতে গলিতে লুকিয়ে আছে হাজারও গল্প। সেই গল্পগুলোতেই ক্যামেরা বন্দি করার নেশায় প্রায় প্রতিদিনই পটুয়াপাড়ার গলিতে উৎসাহীদের ভিড়। প্রতি বছরই এই সময় ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়েন তাঁরা। খোঁজ চলে ভালো ছবি তোলার।
যদিও করোনার জন্য গত বছর থেকে উৎসাহীদের ভিড় কিছুটা কম হলেও বেশ অনেক ক্যামেরাই ঘুরে বেড়াচ্ছে এলাকায়। শুধু কলকাতা সহ বিভিন্ন রাজ্য থেকেও অনেকেই এই সময়ে বনগাঁয় ছুটে আসেন ছবি তোলার নেশায়।
মুম্বাই থেকে ছবি তোলার নেশায় প্রতি বছর পটুয়া পাড়ায় ছুটে আসছেন পলাশ রঞ্জন ভৌমিক৷ কর্মসূত্রে মুম্বাই থাকলেও বনগাঁয় রয়েছে তাঁর বসত বাড়ি৷ পুজোর সময় এসে থাকেন সেখানেই, উদ্যেশ্য তাঁর একটাই দেবীর প্রস্তুতি থেকে শুরু করে ইছামতি নদীতে বিসর্জনের ছবি তোলা । তাঁর কথায়, “ছবি তোলার জন্য কলকাতার কুমোরটুলির পরে বনগাঁর শিমুলতলার পটুয়া পাড়ার থেকে ভালো কিছু হতে পারে না। এখানে অনেক নতুন বিষয় পাওয়া যায়।” সেইসব বিষয়কেই ক্যামেরা বন্দি করে খুশি তিনি।
বেনারস কে যদি ফটোগ্রাফারদের স্বর্গ বলা হয় তাহলে দুর্গাপুজো অবশ্যই বাঙালি ফটোগ্রাফারদের প্রধান ফটো উৎসব। কুমোরটুলিতে প্রতিমার ঘড় বাধা থেকে শুরু করে গঙ্গায় প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত এত বৈচিত্রময় বিষয়, দৃশ্য এবং মানুষের ভাবাবেগ আর কোনো উৎসবে পাওয়া যায় বলে আমার জানা নেই।
ফটোগ্রাফাররা যে এই উৎসবকে নিজের নিজের মতো করে একশ শতাংশ ব্যবহার করার চেষ্টা করবেন এটাই স্বাভাবিক। শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় নয়, বিভিন্ন ফটোগ্রাফির প্রতিযোগিতায় নিজের তোলা ছবি দিয়ে অংশগ্রহণ করেন পেশায় শিক্ষক কৃষ্ণন্দুবাবু।
গত বছর করোনার কারণে পটুয়াপাড়ায় আসতে পারেননি অভিষেক মন্ডল । কিন্তু এবার পরিস্থিতি একটু পরিবর্তন হতেই করোনাবিধি মেনেই ছবি তুলতে নেমে পড়েছেন পটুয়া পাড়ার গলিতে।
তাঁর কথায়, “পেশার তাগিদেও অনেকে আসে এখানে, কিন্তু আমি নেশার তাগিদেই প্রতিবছর এখানে আসি। নতুন নতুন ছবি দিয়ে নিজের গ্যালারি ভর্তি করতে চাই। আবারও আসব যখন মায়ের চক্ষুদান হবে।”
সেই একই সুরে সুর মিলিয়ে সহিদুল মোল্লা বলেন, “ বনগাঁর শিমুলতলার পটুয়া পাড়ার গলিটা আমাদের কাছে একটা ইমোশন। সেই ইমোশনের টানেই বহু বছর ধরে এই এখানে ছবি তুলতে আসি।”
ছোট থেকেই পুজোর সময় প্রায়প্রতিদিনই পটুয়াপাড়ার গলিতে ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়ান সোমনাথ মজুমদার । স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ফটো তোলার নেশা, সেই নেশাতেই ক্যামেরা কেনা। আর তারপর থেকে ক্যামেরা হাতে বেরিয়েপড়া বনগাঁর অলিতে গলিতে।
তবে তিনি ভিডিও ক্যামেরাটা বেশি পছন্দ করেন, তাঁর কথায়, “ বনগাঁ তো ছবি তোলার খনি, এখানে স্টিল ক্যামেরায় দু’একটা ছবি তুলে মন ভরে না, তাই যতপারি ভিডিওগ্রাফি করি এবং আমার নিজস্ব টিভি চ্যানেল নিউজ নোম্যান্সল্যান্ডে সেই ছবি আপলোড করি সাধারণ মানুষের দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য৷ যাতে বনগাঁর বাইরে যাঁরা থাকেন তাঁরা যেন বনগাঁর পুজো উপভোগ করতে পারেন৷
শুধু ছবি নয়, এই সময়ে পটুয়াপাড়ার গলি হয়ে ওঠে বিভিন্ন শর্ট ফিল্ম বা গানের বা অ্যালবামের শুট করতে। এছাড়াও পুজোর বিজ্ঞাপনের শুটেও ব্যবহার হচ্ছে পটুয়া পাড়ার দৃশ্য৷
তেমনই এক মডেল তানিয়া বসু বলেন, “ এখানে মায়ের মূর্তি তৈরি হয়। আর মেয়েরা তো মায়েরই একটা রূপ। তাই সেই রূপ এখানে তুলে ধরা এবং দেবী রুপে কাজ করতে পেরে ভাল লাগছে।”
শিল্পী সেন্টু ভট্টাচার্য বলেন, এখানে ছবি তোলার জন্য কোন গাঁটের কড়ি খরচ করতে হয় না ফটোগ্রাফারদে বা ছবি প্রেমীদের। এবং কোন পাস করাতে হয় ফটো প্রেমীদের। তাঁরা ফটো তোলেন তাঁদের ইচ্ছামত আমাদেরও ভাল লাগে যখন সমস্ত ফটোগ্রাফার, মডেলরা দল বেঁধে আসেন এখানে ছবি তোলার জন্য, একসঙ্গে একাধিক ক্যামেরার শাটারের শব্দ শুনে মনে হয় যেন অসুর দমন করতে মা দূর্গা অস্ত্র ব্যবহার করছেন৷
মৃৎশিল্পী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, “যাঁরা এখানে ছবি তুলতে আসছেন তাঁরা যেন করোনা বিধি মেনে চলেন, অনেক দুঃস্থ শিল্পী রয়েছন আমাদের তো আর আলাদা কোনও রোজগার নেই। তাই এই সময়টা খুবসাবধানে থাকতে হবে সবাইকে৷।”